মনুষ্য সমাজে শকুনকে অশুভ ও অমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে ভাবা হতো। কাকও তাই। মূলত এটি ছিল একটি সামাজিক কুসংস্কার। বাস্তবে শকুন তা নয়। প্রকৃতপক্ষে কাক ও শকুন হলো প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী। প্রকৃতি ও পরিবেশ স্বাভাবিক নিয়মেই নিজের সুরক্ষার জন্য কিছু নিয়মকানুন করে থাকে। জগত ও জীবনের স্বাভাবিক ধর্ম সৃজন ও মৃত্যু। এটি একটি বৃহৎ ও সুপরিসর জীবনচক্রের অংশ। মানুষের মতো প্রকৃতিজাত গাছপালা, পশু-পাখি-প্রাণী ইত্যাদিরও মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। সে অবস্থায় পশু-পাখি-প্রাণীর স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও অনতিপরেই তা পচেগলে দুর্গন্ধ ছড়ায়, জীবাণু দ্বারা দূষিত করে জলাশয়, বনাঞ্চল, অবাসভূমি সর্বোপরি প্রকৃতি ও পরিবেশ। সে অবস্থায় প্রকৃতি ও পরিবেশকে স্বাভাবিক নিয়মে সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা প্রদানের জন্য এগিয়ে আসে কুকুর-বিড়াল-শিয়াল-হায়েনা সর্বোপরি কাক ও শকুন। এগুলো প্রায় সবই প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চিহ্নিত। তবে শকুন ও কাক সবার সেরা বলে বিবেচিত। এরা একেবারে নিকৃষ্টতম পচা-গলা-জীবাণুযুক্ত-পূতিগন্ধময় জীবজন্তুও দিব্যি খেয়ে হজম করে ফেলে। আগে মৃত পশু-পাখি-প্রাণী ফেলার স্থান ছিল ভাগাড়ে। আর ভাগাড়কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠত শকুনের বিচরণস্থল। সময়ের আবর্তে এবং জনসংখ্যাধিক্যে ভাগাড়ের স্থানও চলে গেছে বেদখলে। বনাঞ্চল হয়ে পড়েছে সঙ্কুচিত। দেশ ও জনসংখ্যা অনুপাতে যেখানে বনাঞ্চলের পরিমাণ থাকার কথা পঁচিশ শতাংশ, সেখানে সাকুল্যে আছে বড়জোর আট শতাংশ। সে অবস্থায় শকুন-শেয়াল আর যাবে কোথায়? কাকও কমার পথে। প্রধানত খাদ্যাভাব ও আবাসস্থলের অভাবহেতু শিয়াল-শকুন-কাকসহ অন্যান্য পশু-পাখি-প্রাণী বর্তমানে প্রায় বিলুপ্তির পথে। মাঝেমধ্যে নিতান্তই খাদ্যাভাবে হনুমান, বাঁদর, অজগর, বনবিড়াল অথবা শুকুনের মতো দু’চারটি প্রাণী লোকালয়ে ঢুকে পড়লে প্রায়ই সেগুলোকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। সজ্ঞানেই হোক অথবা অজ্ঞানে, আমরা যে প্রতিনিয়ত প্রকৃতি ও পরিবেশের কত বড় সর্বনাশ করে চলেছি তা মনেও রাখি না।
ঝাড়ে-বংশে শকুনের সর্বনাশ হওয়ার অবশ্য অন্যবিধ কারণও আছে। গৃহপালিত গবাদিপশুকে মোটাতাজাকরণ ও নীরোগ রাখার জন্য হরহামেশাই খাওয়ানো হয় এ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ডাইক্লোফেনাক, কিটোপ্রোফেন ইত্যাদি। শকুনের অকালমৃত্যুর জন্য এই ওষুধগুলো যথেষ্ট। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিনের গবেষক-চিকিৎসক ড. লিন্ডসে ওক প্রমাণ করেন যে, পশু চিকিৎসকদের প্রায় অবাধে ডাইক্লোফেনাকের ব্যবহারই শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। কেননা, শকুন মৃত গবাদিপশুর মাংস ভক্ষণ করে থাকে বিধায় ডাইক্লোফেনাকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শকুনের মৃত্যু ঘটে। সেই থেকে ডাইক্লোফেনাফ নিষিদ্ধ করা হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, এমনকি ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়ও। বাংলাদেশেও ওষুধটি নিষিদ্ধ। তারপরও ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই এ ব্যাপারে কঠোর নজরদারি আবশ্যক। পশু চিকিৎসকদের এ বিষয়ে আরও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে।
তবে আশার কথাও কিছু আছে বৈকি। বাংলাদেশের বার্ডলিস্ট অর্গানাইজেশন, গাজীপুরের ভালচার ব্রিডিং সেন্টার জাতীয় দু’একটি সংস্থা ও সংগঠন শকুন রক্ষায় কিছু কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ইতোমধ্যে। চুনারুঘাটের রেমাকালেঙ্গা বনে সংরক্ষিত হয়েছে শকুনের খাবার স্টেশন। উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বাংলা শকুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির শকুনের বংশ বৃদ্ধির। মোটকথা, সর্বস্তরে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব হলে শকুন ও কাকসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার কাজটি অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে উঠবে।