
“সমুদ্রকে দেখে মানুষ বিস্ময়ে থামে। এখন আমাদের থামতে হবে—সমুদ্রকে রক্ষা করতে।” রবিবার ৮ জুন, বিশ্ব সমুদ্র দিবস।আমাদের জীবন, শ্বাস ও খাদ্যের মূল যোগানদাতা লুকিয়ে আছে সমুদ্রের অতল গহ্বরে। বিশাল এই নীল জলরাশি পৃথিবীর প্রাণস্রোতের উৎস, যেখানে প্রতিদিন নতুন আলো ফোটে, আবার নতুন বিপদের ছায়াও ফেলে।
পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশ ভূভাগ ঢাকা রয়েছে পানি দিয়ে, যার ৯৭ শতাংশই সমুদ্রজল। এখান থেকেই আসে আমাদের বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদান অক্সিজেনের অন্তত অর্ধেক। সামুদ্রিক ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন নামে একধরনের শৈবালজাত ক্ষুদ্র জীব এই অক্সিজেন উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শুধু শ্বাস নয়, খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি ও পরিবহন সব ক্ষেত্রেই সমুদ্রের প্রভাব অনস্বীকার্য। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩০০ কোটিরও বেশি মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সমুদ্রনির্ভর পেশার সঙ্গে জড়িত।এই বিশাল জলরাশি সম্পদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে শুধুই অবহেলা।
বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮ থেকে ১২ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য গিয়ে পড়ে সমুদ্রে। গড়ে প্রতি মিনিটে একটি ট্রাকভর্তি প্লাস্টিক এই নীল জলরাশিতে ঢুকে পড়ে। সামুদ্রিক প্রাণিদের গলাধঃকরণ, ডিম ফোটার সময় ব্যাঘাত এবং খাদ্যশৃঙ্খলা ভেঙে দেওয়ার মতো ভয়ংকর প্রভাব ফেলে এসব প্লাস্টিক। ভারতের তামিলনাড়ু উপকূলে এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক কেজি মাছের পেটে পাওয়া গেছে গড়ে তিন থেকে সাতটি প্লাস্টিক কণা। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা উপকূলে সাম্প্রতিক একাধিক গবেষণায় বিপজ্জনক মাত্রায় মাইক্রোপ্লাস্টিক শনাক্ত হয়েছে। এই প্লাস্টিক যখন খাবারের শৃঙ্খলে ঢুকে পড়ে, তখন সেটা শুধু মাছ নয়, মানুষের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।
২০১২ ও ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক আইনি রায় অনুযায়ী বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার জলসীমা অর্জন করে। এ বিশাল সমুদ্রাঞ্চল দেশের জন্য এক সুবর্ণ সম্ভাবনা যা ‘সুনীল অর্থনীতি’ বা ব্লু ইকোনমি নামে পরিচিত। সামুদ্রিক মাছ ও শুঁটকি শিল্প, জাহাজ ও বন্দর ব্যবসা, গভীর সমুদ্র পর্যটন এবং খনিজ সম্পদের খনি সব কিছু মিলিয়ে এটি হতে পারে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার জায়গা। তবে এই সম্ভাবনার পূর্ণ ব্যবহারে বাংলাদেশের প্রস্তুতি এখনও অপূর্ণ।বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ থাকলেও বাজেট, যন্ত্রপাতি ও উপাত্ত সংগ্রহের মতো মৌলিক সুবিধার ঘাটতি প্রকট। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় অনেক মাছের প্রজাতি স্থান বদলাচ্ছে, ডিম ফোটার সময়ও পাল্টে যাচ্ছে। ফলে মাছ ধরার মৌসুমে ধস নেমেছে। শুধু তাই নয়, উপকূলজুড়ে বাড়ছে লবণাক্ততা, জমি ক্ষয় এবং ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা।
বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যে সমুদ্র ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ইউরোপের অনেক দেশ এখন ড্রোন, স্যাটেলাইট ও রিমোট সেন্সিংয়ের মাধ্যমে সমুদ্র তলদেশ পর্যবেক্ষণ করছে, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করছে ও মৎস্যসম্পদ নিয়ন্ত্রণ করছে। বাংলাদেশে এখনো এমন প্রযুক্তিভিত্তিক মডেল তৈরি হয়নি।
সমুদ্রের নীরবতার সুযোগ নিয়ে আমরা তাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। প্লাস্টিকে ঢেকে যাচ্ছে তার শরীর, উষ্ণতায় ঘোলাটে হচ্ছে তার হৃদয়। এখনই যদি আমরা সমুদ্রের দিকে ফিরে না তাকাই, তাহলে একদিন সে-ই হয়তো মুখ ফিরিয়ে নেবে আমাদের কাছ থেকে। তখন আর শুধরে নেওয়ার সুযোগ থাকবে না। তাই সমুদ্র রক্ষা মানে শুধু পরিবেশ রক্ষা নয়, এটা আমাদের ভবিষ্যৎ রক্ষার লড়াই।
রিফাত