ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দশম দিনের বৈঠক

জরুরি অবস্থা জারির বিধান পরিবর্তনে একমত দলগুলো

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:৪৪, ৭ জুলাই ২০২৫

জরুরি অবস্থা জারির বিধান পরিবর্তনে একমত দলগুলো

জরুরি অবস্থা ঘোষণা কোনো পরিস্থিতিতেই যেন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত না হয়

জরুরি অবস্থা ঘোষণা কোনো পরিস্থিতিতেই যেন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত না হয়, সেটা নিশ্চিত করার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে পর্যায়ক্রমে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও একমত পোষণ করেছে দলগুলো। এক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থানে যেসব উপজেলা জেলা সদরের নিকটবর্তী, সেখানে আদালত স্থাপনের বিপক্ষে দলগুলো। একইভাবে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জরুরি অবস্থা জারির নতুন বিধান কি হবে, তা নিয়ে নানা প্রস্তাব থাকলেও বিদ্যমান বিধান পরিবর্তনে সকলেই একমত।
সোমবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দিনভর দ্বিতীয় ধাপের দশম দিনের সংলাপ শেষে ঐকমত্য কমিশন এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব কথা বলেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে সোমবারের বৈঠকে কমিশনের সদস্য ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন। 
দশম দিনের সংলাপে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, সিপিবি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশগ্রহণ করেন। 
বৈঠক শেষে ব্রিফিংকালে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড.আলী রীয়াজ বলেন,  জরুরি অবস্থা ঘোষণা কোনো পরিস্থিতিতেই যেন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত না হয়, সেটা নিশ্চিত করার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত। তিনি বলেন, বিদ্যমান সংবিধানের ১৪১ নং অনুচ্ছেদের (ক), (খ), (গ) এর সমস্ত কিছুর ক্ষেত্রে সংশোধন, সংযোজন, বিয়োজন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করার বিষয়েও দলগুলো একমত।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের সোমবার  জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও  উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত জসম্প্রসারণ- এ দুটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে? বিদ্যমান সংবিধানের ১৪১ নং অনুচ্ছেদে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিষয়টি আছে, যা নিয়ে অতীতে খুব বেশি আলোচনার সুযোগ ছিল না। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। পূর্ববর্তী আলোচনাগুলোর প্রেক্ষিতে ঐকমত্য কমিশন হতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিষয়ে সংশোধিত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে? এই প্রস্তাব নিয়ে পরবর্তী সভায় অধিক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

ভবিষ্যতের আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে বলা যাবে এ বিষয়ে কতটুকু একমত হওয়া গেছে? 
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলো উপজেলা পর্যায়ে পর্যায়ক্রমে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে একমত পোষণ করেছে বলে জানান তিনি? তবে দল এবং জোটগুলো অধস্তন আদালত সম্প্রসারণের জন্য কিছু বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন বলে মনে করে? যেমন, সদর উপজেলাসমূহের আদালতসমূহ জেলা জজকোর্টের সঙ্গে সংযুক্ত রেখে সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে? 
তিনি বলেন, বিদ্যমান চৌকি আদালত, দ্বীপাঞ্চল এবং ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত আদালতসমূহ বহাল রেখে এর প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। জেলা সদরের কাছাকাছি উপজেলাসমূহে নতুন আদালত স্থাপনের প্রয়োজন নেই? এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জরিপের দরকার? অবশিষ্ট উপজেলাগুলোর জনসংখ্যার ঘনত্ব, ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য, যাতায়াত ব্যবস্থা, দূরত্ব, অর্থনৈতিক অবস্থা, মামলার সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে পর্যায়ক্রমে স্থাপন করা? অধস্তন আদালতের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা। আইনগত সহায়তা কার্যক্রম উপজেলা পর্যায়ে পর্যন্ত  সম্প্রসারিত করা? 
বৈঠক শেষে রাজনৈতিক দলের নেতারা যা বলেন ॥ বৈঠক শেষে ব্রিফিংকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত গঠন ও জরুরি আইন সংস্কারে বিএনপির আপত্তি নেই। এ নিয়ে অন্য দলগুলোও ঐকমত্যে পৌঁছেছে। তবে এ ক্ষেত্রে আইনের সঠিক প্রয়োগ হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, জনগণের দোরগোড়ায় আইনি সেবা পৌঁছে দিতে উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণের বিষয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই একমত হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন কেউ কেউ।
সালাহ উদ্দিন আহমদ  বলেন, প্রথমত জেলা সদরে জেলা জজ আদালত বিদ্যমান থাকায় সেখানে নতুন করে আদালতের প্রয়োজন নেই। আমার জানা মতে, সারাদেশে উপজেলা আদালত রয়েছে ৬৭টি। সেগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জেলা সদর ১৫-২০ কিলোমিটার সীমার মধ্যে থাকলে বা সুযোগ-সুবিধা থাকলে সেখানেও প্রয়োজন নেই। তৃতীয়ত, জন-ঘনত্ব ও অর্থনৈতিক বিবেচনা করে কিছু উপজেলায় অধস্তন আদালত বিকেন্দ্রীকরণ করা যেতে পারে। এ বিষয়ে আরও আলোচনার দাবি রাখে তিনি।
বিএনপি কেন উপজলা আদালত তুলে নিল এমন প্রশ্নের জবাবে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার হওয়ার পর তখনকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বন্ধ করা হয়। হয়তো তখনকার বাস্তবতা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে ৩৫ বছর পর নতুন বাস্তবতার কারণে আবার এর পক্ষে প্রস্তাব এসেছে।
জরুরি আইনের সংস্কারের বিষয়ে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের কোনো প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবেন, কী কী শর্ত থাকবে, সংসদ থাকলে বা না থাকলে কোন্ প্রক্রিয়ায় হবে, সেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বিষয়, মৌলিক বিষয় পরবর্তী সংসদে আলোচনার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জরুরি অবস্থা জারি থাকা অবস্থায় যেন মৌলিক ও মানবাধিকার খর্ব করা না হয়, সে বিষয়ে সবাই একমত। আমাদেরও আপত্তি নেই। কোনো কারণে যেন অপব্যবহার না হয়। এ নিয়ে আরও আলোচনা করতে হবে।
আলোচনায় অংশ নেওয়া কয়েকটি দলের নেতা উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত স্থাপন করা হলে দুর্নীতি বাড়বে আশঙ্কা করেন। বিষয়টিতে দ্বিমত জানান জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ। তিনি বলেন, উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত হলে দুর্নীতি বাড়বে এটা ভুল ধারণা। বিচার প্রার্থীকে হয়রানি রোধ করতে বিচারের সেবা জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। দুর্নীতির বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে হবে এবং স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বিচার বিভাগ। কিন্তু বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে তৃণমূল পর্যায়ে অনেক সময় বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। জেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত থাকলেও উপজেলা পর্যায়ে নেই। তাই উপজেলা পর্যায়ে আদালত বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে সমর্থন করে জামায়াত। কারণ, আমরা বিচার বিভাগকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে চাই।
উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত স্থাপনে তাগিদ দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম-আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন। তিনি প্রয়োজনে সংসদীয় আসনের ভিত্তিতে দ্রুতই অধস্তন আদালত স্থাপনের প্রস্তাব করেন। কত বছরের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণ করা হবে, তা নির্দিষ্ট করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন পরবর্তী সংসদের ওপর দেওয়ার পক্ষে নয় এনসিপি। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে নতুন রাজনৈতিক কাঠামো ও নয়া বন্দোবস্ত করতে হবে।
আদালতে বিকেন্দ্রীকরণ প্রস্তাবের পক্ষে গণসংহতি আন্দোলন একমত উল্লেখ করে দলটির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, উপজেলা পর্যায়ে অনেক মামলা ও গ্রেপ্তার হয়, কিন্তু জামিন থেকে শুরু করে একেবারে প্রাথমিক কাজের জন্য তাদের জেলায় যেতে হয়। ফলে, অনেক ক্ষেত্রে বড় ধরনের আর্থিক চাপ থাকে। অনেক সময় মামলার জন্য জেলায় গিয়ে থাকতেও হয়। তাই উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণ হলে তা প্রতিটি উপজেলায় হওয়া দরকার। সংসদীয় আসন কিংবা অন্যকিছু বিবেচনা করা হলে তাহলে এক অঞ্চলের সঙ্গে আরেক অঞ্চলে দ্বন্দ্ব বাড়বে। 
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে জরুরি অবস্থা জারির বর্তমান বিধান ছিল না। পরবর্তীতে এটা যুক্ত করা হয়েছে এবং তা অপব্যবহার করা হয়েছে। যুদ্ধাবস্থা ও বহিঃআক্রমণ ছাড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থার জারি বন্ধ করতে হবে। জরুরি অবস্থা জারি হলে কোনোভাবেই নাগরিক ও মৌলিক অধিকার খর্ব করা যাবে না। আর সার্বিক সমীক্ষা শেষ করে প্রয়োজনীয়তা সাপেক্ষে উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ এলডিপির প্রেসিডিয়াম সদস্য হাসান সোহরাওয়ার্দী বলেন, ১৭৫টি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করার বিধান রয়েছে। সেগুলো পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল আছে, তাদের তদন্ত রিপোর্ট সাপেক্ষে পরিস্থিতি বিবেচনায় জরুরি অবস্থা জারি করা যেতে পারে।

×