ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৫ বৈশাখ ১৪৩২

ভুল বার্তা যাবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে

আইওএফ বাতিলের সিদ্ধান্তে অসন্তোষ, ঝুঁকিতে ৩০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০০:২৬, ৯ মে ২০২৫

আইওএফ বাতিলের সিদ্ধান্তে অসন্তোষ, ঝুঁকিতে ৩০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ

আইওএফ বাতিলের সিদ্ধান্তে অসন্তোষ

কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়াই আন্তর্জাতিক গেটওয়ে অপারেটরস ফোরাম (আইওএফ) বাতিলে হুমকির মুখে পড়েছে আইজিডব্লিউ (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে) খাতের ৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। গত সরকারের সময় এ খাতের ৯২১ কোটি টাকা লুটে জড়িত সালমান এফ রহমানসহ ৬ আইজিডব্লিউ কোম্পানির মালিক ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে।

অভিযোগ উঠেছে, গত সরকারের প্রভাবশালী টেলকো ব্যবসায়ীদের ফের অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যে ফিরিয়ে আনতে কৌশলে আইএফও বাতিলের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে লুটপাটকারীদের আইনের হাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চুক্তি বাতিল করায় দেশের আইজিডব্লিউ কোম্পানিগুলো হতবাক। তারা বলছে, আন্তর্জাতিক গেটওয়ে অপারেটরস ফোরাম (আইওএফ) বাতিলে এখাতের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়েছে। এতে আন্তর্জাতিক কল আদান প্রদানে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হবে। বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে পুরো খাত। 
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সস্প্রতি আন্তর্জাতিক কল আদান প্রদানে নিয়োজিত ২৩টি আইজিডব্লিউ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে। এই চুক্তি বাতিলের ক্ষেত্রে তারা বেশ কিছু কারণ তুলে ধরেছে। কারণগুলো হলোÑ অনিয়মিত রিপোর্ট জমা, কল বিতরণে অসমতা, বকেয়া পাওনা ও ব্যাংক গ্যারান্টি না দেওয়া, চুক্তি পরিবর্তন, অবৈধ আন্তর্জাতিক কল বন্ধে ব্যর্থতা এবং নেটওয়ার্ক টপোলজি বাতিল।

তবে এই অভিযোগগুলো নিয়ে কোনো প্রকার কারণ দর্শানো বা অবস্থান ব্যাখ্যার সুযোগ না দিয়ে চুক্তি বাতিল করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আইওএফ। তারা বলছেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়নি, যা অত্যন্ত হতাশাজনক এবং অবিবেচনা প্রসূত। আইওএফের দাবি, চুক্তি বাতিলের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি এবং অভিযুক্ত পক্ষগুলোকে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। 
এ প্রসঙ্গে আইওএফ প্রেসিডেন্ট আসিফ সিরাজ রব্বানি বলেন, ‘বিটিআরসি কোনো ধরনের পূর্ব আলোচনা ছাড়াই চুক্তি বাতিল করেছে এবং আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়নি, যা অত্যন্ত হতাশাজনক এবং অবিবেচনা প্রসূত। অন্তত একটি শোকজ নোটিস পেলেও আমরা অভিযোগের জবাব দিতে পারতাম।’  
অংশীজনের সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়া অনেকটা লুকোচুরি ও তড়িঘড়ি করে নেয়া এই সিদ্ধান্তকে তিনি উদ্দেশ্যমূলক ও বিনিয়োগ বিরূদ্ধ বলে অভিহিত করেন। তিনি আরও বলেন, প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যখন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট চেষ্টা করছেন তখন নিয়ন্ত্রণ সংস্থার এই সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের ভুল বার্তা দেবে।
তিনি দাবি করেন, আইওএফ গঠনের আগে ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ছয়টি আইজিডব্লিউ যেখানে প্রায় ৯২১ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছিল, সেখানে ২০১৫ সালে আইওএফ গঠনের পর থেকে রাজস্ব খাতে মোট ৫,৬০৭ কোটির বেশি টাকা জমা হয়েছে। যার মধ্যে ৪,৩৪২ কোটি রাজস্ব অংশীদারিত্ব, ৬৩৫ কোটি লাইসেন্স ফি, এবং ৬৩০ কোটি টাকায় ভ্যাট ও অগ্রিম আয়কর রয়েছে।

কাজেই এ রকম গুরুত্বপূর্ণ একটি সংগঠনকে কোনো কিছু না জানিয়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার একতরফা সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। এতে  ফ্যাসিস্ট সরকার আমলে মাত্র ছয়টি কোম্পানির আন্তর্জাতিক কলের ৯২১ কোটি টাকা লুট করে পালিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।  
অভিযোগ রয়েছে বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো কম্পিউটারের সঙ্গে বিটিআরসির অনুমোদনে তদানীন্তন আইওএফয়ের সঙ্গে চুক্তি হয়। এ চুক্তির কারণে এমডিএস ফান্ডের মাধ্যমে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা চলে যায় সালমান রহমানের প্রতিষ্ঠানে। ব্যবসা উন্নয়নে নামে মাত্র কিছু অর্থ ব্যয় হলেও বেশিরভাগ অর্থের গন্তব্য নিয়ে বড় প্রশ্ন রয়েছে।
বর্তমান আইওএফ সভাপতি আসিফ সিরাজ রব্বানী দাবি করেন, ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রথমেই এমডিএস (মার্কেট ডেভেলপমেন্ট এক্সপেন্সেস) ফান্ড বাতিল করেন। এই বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে বের করা হোক কারা কিভাবে অনিয়ম করেছে। আমরা নিয়ম মেনে ব্যবসা করতে চাই। ফ্যাসিস্ট সরকারের লোকজনের অনিয়মের দায় আমাদের কেন নিতে হবে?
বিটিআরসির সিদ্ধান্তের পেছনের অভিযোগগুলো প্রসঙ্গেও আইওএফ ব্যাখ্যা দিয়েছে। বিশেষ করে, অনিয়মিত রিপোর্ট জমার অভিযোগের বিষয়টি আইওএফের তরফ থেকে অস্বীকার করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আইওএফের চিফ অপারেটিং অফিসার মুশফিক মনজুর জানান, প্রতিদিন এবং মাসিক ভিত্তিতে আইজিডব্লিউ ও আইওএস অনুযায়ী ট্রাফিক রিপোর্ট এবং বিস্তারিত আর্থিক তথ্য ধারাবাহিকভাবে কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। আজ পর্যন্ত বিটিআরসির কোনো নির্দেশনা আইওএফ অগ্রাহ্য করেনি।
কল বিতরণে অসমতা নিয়ে বিটিআরসির অভিযোগ প্রসঙ্গে আইওএফ জানিয়েছে, প্রযুক্তিগত কারণে এই সমস্যা দেখা দিয়েছিল। নভেম্বর ২০২৩ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত খাজা টাওয়ার পয়েন্ট অব ইন্টারকানেকশনে আগুন লাগার কারণে বড় ধরনের সার্ভিস ব্যাঘাত ঘটে। তবুও ১৩টি আইজিডব্লিউ ও ৬টি আইওএস সীমিত পরিসরে কাজ চালিয়ে যায়।

এ সময়ে সমানভাবে কল বিতরণ প্রযুক্তিগতভাবে সম্ভব ছিল না এবং বিটিআরসি কে তা জানানো হয়েছিল। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ফ্যাসিস্টবিরোধী আন্দোলনের সময় সরকারি নির্দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হয়ে গেলে সার্ভিস মারাত্মকভাবে বিঘিœত হয়।
বকেয়া পাওনা ও ব্যাংক গ্যারান্টির বিষয়ে আইওএফ জানিয়েছে, এখানে অভিযোগের কোনো সুযোগ নেই। কারণ সকল আইজিডব্লিউ অপারেটরের পক্ষ থেকে বিটিআরসিতে ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদান করা আছে, যা থেকে চাইলে যে কোনো সময় বিটিআরসি পাওনা রাজস্ব আদায় করে নিতে পারে। ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত সব আইজিডব্লিউ অপারেটর বিটিআরসিকে নিয়মিত পেমেন্ট করে আসছে।

কেবল দুটি আইজিডব্লিউর অ্যাকাউন্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ফ্রিজ করে। ফলে তাদের সামান্য কিছু অর্থ বকেয়া পড়ে যায়। ওই অ্যাকাউন্টগুলোও বর্তমানে সচল। একটি অপারেটর ইতমধ্যে পাওনা পরিশোধের জন্য আবেদন করলেও  বিটিআরসির দিক থেকে এখনো কোনো সাড়া মেলেনি।
২০২৪ সালের ৩ ডিসেম্বর বিটিআরসি তিনটি আইজিডব্লিউর কার্যক্রম স্থগিত করে। অভিযোগ ছিলÑ বকেয়া পাওনা ও কল বিতরণে অসমতা। আইওএফ বলছে, এ সিদ্ধান্ত কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা ছাড়াই এবং আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে নেওয়া হয়েছে।
চুক্তি পরিবর্তনের অভিযোগ প্রসঙ্গে আইওএফের ব্যাখ্যা হচ্ছেÑ বিটিআরসির পূর্বানুমোদন ছাড়া কখনো কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। ২০২৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রেভিনিউ শেয়ারিং পার্টনার (আরএসপি) অনুপাতে সামান্য পরিবর্তনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিটিআরসি অনুমোদন না করায় পরে তা আর কার্যকর হয়নি।
এ ছাড়াও ৩ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে বিটিআরসি তিনটি ধারা পরিবর্তনের নির্দেশনা দেয়। আইওএফ একটি ধারা নির্দেশনা গ্রহণ করে। বাকি দুটির জন্য বিকল্প প্রস্তাব দেয়, যা ৩০ জানুয়ারি ২০২৫ সালে অনুমোদনের জন্য জমা দেয়। ৭ ফেব্রুয়ারি একটি বৈঠকে আইওএফ প্রেসিডেন্ট কমিশনের সামনে ফোরামের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। সে বিষয়ে এখনো বিটিআরসি পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক জবাব আসেনি।
অবৈধ আন্তর্জাতিক কল বন্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ প্রসঙ্গে আইওএফের ভাষ্য হচ্ছে, অবৈধ কল রোধ করা সরকারের ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অধীনে পড়ে। এখানে আইওএফের বিশেষ কোনো দায় ও কর্তৃত্ব নেই। তবুও আমরা বিটিআরসির নির্দেশনা মেনে যখন যেখানে প্রয়োজন সর্বোচ্চ লজিস্টিক সহায়তা দিয়েছি। বিটিআরসি সদর দপ্তরে রিয়েল টাইম কল মনিটরিং সিস্টেম আমরা নিজের খরচে স্থাপন করে দিয়েছি।

বিটিআরসি আইজিডব্লিউ আয়ের ৪০ শতাংশ পায়, তাই আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি ও পেমেন্ট তাদেরই করা উচিত। কিন্তু আইওএফকেই তারা এই কাজ করার নির্দেশনা দেয়। নেটওয়ার্ক টপোলজি বাতিল প্রসঙ্গে এই খাত সংশ্লিদের অভিমত হলো, বিটিআরসির এই একতরফা পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশনকে অ-ধারাবাহিক ও অস্থিতিশীল করে তুলবে এবং আইওএফ গঠনের পর এই খাতে যে অগ্রগতি ও শৃঙ্খলা এসেছে, তা বিনষ্ট করতে পারে। বিশেষ করে প্রতিটি অপারেটরকে এখন আলাদাভাবে মনিটর করতে হবে।

×