
গণহত্যায় জড়িতরা এখনো অধরা
রাজধানীর মতিঝিলে শাপলা চত্বরে ১২ বছর আগে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচিতে রাতের অন্ধকারে চালানো হয়েছিল নির্মম ও নিষ্ঠুর গণহত্যা। ২০১৩ সালের ৫ মে’র মহাসমাবেশে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির তৎকালীন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা রাতের অভিযান ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’য় কতজন নিরীহ সাধারণ মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্রকে হত্যা করা হয় তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি। তবে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ থেকে একটি খসড়া তালিকা করা হয়েছে যেখানে ৯৩ জনের মৃত্যুর তথ্য দেওয়া হয়েছে।
৫ই মে ২০১৩ ভোর পাঁচটায় ফজরের নামাযের পরই ঢাকার প্রবেশপথগুলো দখলে নিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। ঢাকার উত্তরে গাবতলী বাস টার্মিনাল, টঙ্গী এবং দক্ষিণে সায়দাবাদের কাছে কাঁচপুর ব্রিজসহ রাজধানীকে ঘিরে ছয়টি প্রবেশমুখেই অবরোধ তৈরি করেছিলেন হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সারাদেশ থেকে আসা বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসার হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে অবরোধকারীদের মাঝে উত্তেজনা ছড়াতে থাকে। হেফাজতে ইসলামের একজন নেতা দাবি করেন, অনেকটা আকস্মিকভাবেই তারা ঢাকায় প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এর আগে হেফাজতে ইসলামের নেতারা শাপলা চত্বরে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর অনুমতির জন্য পুলিশের সাথে আলোচনা শুরু করেন। সকালে দফায় দফায় তাদের আলোচনা চলে। সকাল সাড়ে ১১টায় অনুমতি মেলার আগেই কয়েকটি মিছিল ঢুকে পড়ে ঢাকায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেছেন, শেষ পর্যন্ত পুলিশ অনুমতি দিয়েছিল শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার জন্য। এর মধ্যে বেলা বারটার দিকে সংঘর্ষ হয় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কাছে । সেখানে হেফাজতে ইসলামের মিছিলে আওয়ামী লীগের একদল নেতা কর্মী হামলা চালায়। কিন্তু অন্যদিকে, পল্টন মোড় থেকে বায়তুল মোকারম মসজিদের চারপাশের রাস্তায় বিভিন্ন ভবনে অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ সহিংসতা চলতে থাকে। পুলিশও দফায় দফায় গুলি চালায়।
যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিয়েছিল গোটা এলাকা। দিনের এই সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন হতাহতও হয়। তবে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায় শাপলা চত্বরে হেফাজতের নেতাদের বক্তব্যে সেখানে অবস্থান করার ঘোষণা আসতে থাকে। রাত সাড়ে দশটায় হেফাজতে ইসলামের প্রধান শাহ আহমদ শফিকে লালবাগ মাদ্রাসা থেকে নিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে রওনা দেয়। পরে তাকেও সেখানে আসতে দেয়া হয়নি পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। রাত সোয়া একটায় শুরু হয় সেই রাতের অভিযানের প্রস্তুতি।
পুলিশ, র্যাব,বিজিবির হাজার হাজার সদস্য তখন দৈনিক বাংলার মোড়, দিলকুশা, ফকিরাপুল এবং নটরডেম কলেজের সামনে অবস্থান নিয়েছে। অবস্থানকারীদের সরে পড়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে কমলাপুর স্টেশন যাওয়ার রাস্তা এবং বঙ্গভবনের দিকের রাস্তা খোলা রাখা হয়েছিল। অন্য তিনদিক থেকে র্যাব , বিজিবি পুলিশ সদস্যরা এগুনোর চেষ্টা করে এবং প্রথমে হাত মাইক ব্যবহার করে অবস্থানকারীদের সরে যেতে বলে। কিন্তু মঞ্চ থেকেও আসতে থাকে উত্তেজনাকর বক্তব্য। ঘণ্টা দেড়েক এভাবে চলে। রাত পৌনে তিনটা। শুরু হয় মূল অভিযান।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তিনদিক থেকে ফাঁকা গুলি, আর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করতে থাকে। থেমে থেমে সাউন্ড গ্রেনেডও ব্যবহার করা হয়। শত শত রাউন্ড গুলি এবং সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ এবং অন্ধকার এলাকায় এসবের আলোর ঝলকানি মুহূর্তেই ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। এই অভিযানের নেতৃত্বে থাকা অন্যতম একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, দশ মিনিটেই তারা পৌঁছে যান শাপলা চত্বরে।
ট্রাকের উপর ভ্রাম্যমাণ মঞ্চও খালি হয়েছিল মুহূর্তেই। তবে সেই মঞ্চের পাশে একটি ভ্যানের উপর কাফনের কাপড় এবং পলিথিন দিয়ে মোড়ানো ৮/১০টি লাশ ছিল। পুলিশ পুরো এলাকার দখল নেওয়ার পর বিভিন্ন ভবনে আশ্রয় নেওয়াদের বের করে এনে ঐ এলাকা ছেড়ে যেতে সহায়তা করে। দেখা গেছে হেফাজতের শত শত কর্মী সমর্থক মাথার উপর দু’হাত তুলে লাইন ধরে পুলিশের কর্ডনের মধ্য দিয়ে ঐ এলাকা ছেড়ে যান।
ভোর চারটা, তখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা থেমে ফাঁকা গুলী করেছে এবং তল্লাশি চালিয়েছে আশেপাশের ভবনগুলোতে। ভোর পাঁচটা, পুরো মতিঝিল এলাকার পরিবেশটা একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকার মতো মনে হয়েছিল। দিনের বেলা অন্তত ১১ জন নিহত হয় পুলিশের গুলিতে। তবে রাতের অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে এখনও সঠিক তথ্য জানা যায়নি। তবে প্রাথমিকভাবে একটি খসড়া তালিকা করা হয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের জনসংযোগ বিভাগের দায়িত্বে থাকা কেফায়েতুল্লাহ আজহারী জনকণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিকভাবে ৯৩ জন শহিদের তালিকা করা হয়েছে। এগুলো নিশ্চিত করার জন্য পুনরাই যাচাইবাছাই চলছে। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচলিত ছিল সেদিন রাতের আঁধারে হাজারের বেশি নিহত হয়েছেন। তবে এ ঘটনায় বেসরকারিভাবে কাজ করা প্রতিষ্ঠান অধিকার ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট তাদের ফেসবুকে ৬১ জনের নাম-পরিচয় প্রকাশ করে।
অন্যদিকে গত ২ মে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে এক পোস্টে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, ওই ঘটনায় কতজন নিহত হয়েছিলেন, তা নিয়ে যখন গোটা বিশ্ব বিভ্রান্ত, তখন তিনি এবং মার্ক ডামেট (তৎকালীন বিবিসি ঢাকা প্রতিনিধি) মিলে দুই সপ্তাহ ধরে মাঠে কাজ করেন। তাদের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ৫ ও ৬ মে’র সহিংসতায় অন্তত ৫৮ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে সাতজন ছিলেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য।
এখন পর্যন্ত একাধিক মামলা হয়েছে শাপলার গণহত্যা নিয়ে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর গত ১৮ আগস্ট গণহত্যার অভিযোগে সাবেক স্বৈরাচার হাসিনাসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। গত বছরের ২৬ নভেম্বর শেখ হাসিনা, সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
সেই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচার হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। শেখ হাসিনা ছাড়াও পরোয়ানাভুক্ত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার, সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার ও বেনজির আহমদ।
অন্য মামলায় কারাগারে থাকায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোল্লা নজরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার দেখানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া আগামী ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনার নির্দেশে শাপলা চত্বর ক্লিয়ার করতে যেসব কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন: আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার, অতিরিক্ত আইজিপি শহীদুল ইসলাম, র্যাবের ডিজি মোখলেসুর রহমান, ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, র্যাব-১০ অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান, র্যাব-৩ মেজর সাব্বির, র্যাব-১ পরিচালক লে. কর্নেল কিসমত হায়াত, র্যাব-৪ পরিচালক কামরুল হাসান, বিজিবির কর্নেল এহিয়া আজম খান, হাইওয়ে রেঞ্জের ডিআইজি আসাদুজ্জামান মিয়া, এসবির অতিরিক্ত ডিআইজি মাহবুব হোসেন, মতিঝিল বিভাগের এডিসি এসএম মেহেদী হাসান, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল জলিল ম-ল, যুগ্ম কমিশনার শেখ মারুফ হাসান, উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন, এডিসি আসাদুজ্জামান, এডিসি মাইনুর হাসান, রমনার এডিসি মঞ্জুর রহমান, ডিবির এডিসি মশিউর রহমান, ডিবি দক্ষিণের এডিসি নাসির উদ্দিন খান, লালবাগের তৎকালীন ডিসি হারুনুর রশীদ ও উপকমিশনার খান মোহাম্মদ রেজওয়ান।
কর্মসূচি: শাপলা চত্বরে সংঘটিত নৃশংস গণহত্যার বিচার দাবিতে আজ সারাদেশের সব বিভাগীয় শহরে মানবপ্রাচীর কর্মসূচি আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। এছাড়া হেফাজত ইসলাম ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন থেকে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।