ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

এনডিবির কাছে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য ২,৩০০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব

পাঁচ সেতু নির্মাণে ৮৮৭ কোটি ডলার চায় সরকার

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:২০, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

পাঁচ সেতু নির্মাণে ৮৮৭ কোটি ডলার চায় সরকার

পাঁচ প্রকল্পে আনুমানিক ৮৮৭ কোটি ডলার ব্যয় হতে পারে

রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্বাধীন নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এনডিবি) কাছে পাঁচটি সেতু নির্মাণে ঋণ চেয়েছে সরকার। পাঁচ প্রকল্পে আনুমানিক ৮৮৭ কোটি ডলার ব্যয় হতে পারে বলে সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি প্রকল্পের একটি হলো বরিশালের সঙ্গে ভোলার সংযোগ স্থাপনে সেতু নির্মাণ পরিকল্পনা। এখানে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা (১৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলার)। এ ছাড়া প্রায় ৩১ হাজার ২০০ কোটি টাকা (২৮০ কোটি ডলার) ব্যয়ে পাটুুুুুুরিয়া-গোয়ালন্দ দ্বিতীয় পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রকল্পও রয়েছে। 
প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, কালাবদর ও তেঁতুলিয়া নদীর ওপর প্রস্তাবিত সেতুটি বরিশালের মূল ভূখ-ের সঙ্গে ভোলার সড়ক সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশে নির্মাণ করা হবে বলে জানায় সেতু বিভাগ। এ ছাড়া সেতু বিভাগের অন্য যে তিন প্রকল্পের জন্য এনডিবিতে ঋণ প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, সেগুলো হলো বাকেরগঞ্জ-বাউফল সড়কে কারখানা নদীর ওপর সেতু, মেঘনা নদীর ওপর ভোলা-লক্ষ্মীপুর সড়কে একটি এবং কক্সবাজারের মহেশখালী চ্যানেলের ওপর একটি টানেল বা সেতু। 
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা জানান, এনডিবির ঋণ পেতে সেতু বিভাগ ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয় বেশকিছু প্রকল্পের ঋণ প্রস্তাব জমা দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এসব প্রকল্পের সম্ভাব্য মোট ব্যয় সর্বোচ্চ দুই হাজার ৩০০ কোটি ডলার হতে পারে।
এনডিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ভøাদিমির কাজবেকভের নেতৃত্বে এনডিবির একটি প্রতিনিধি দল গত ২১ থেকে ২৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ সফর করে। ওই সময় সেতু বিভাগের সঙ্গে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নের বিষয়ে ওই প্রতিনিধি দলের আলোচনা হয়।
এ প্রসঙ্গে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেছেন, বেশকিছু সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। এক্ষেত্রে মাস্টারপ্ল্যানও তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার চূড়ান্ত প্রতিবেদনও পাওয়া গেছে। সেগুলোর পর্যালোচনার কাজ চলছে। এনডিবির সঙ্গে বৈঠকে এসব প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি বলেন, এনডিবির সঙ্গে বৈঠকে সেতু বিভাগ কোনো প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে দেয়নি। এনডিবি তাদের পর্যালোচনা অনুযায়ী, যে সেতুতে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে, সেখানে বিনিয়োগ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
যে পাঁচ সেতুর জন্য ঋণ প্রস্তাব ॥ সেতু বিভাগ ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানান, বরিশাল-ভোলা সড়ক সংযোগের জন্য কালাবদর ও তেঁতুলিয়া নদীর ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। ভারতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসটিইউপি কনসালট্যান্টস চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এখন প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করছে সেতু বিভাগ। একইসঙ্গে প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তাবনা (পিডিপিপি) তৈরির কাজ চলছে। 
কর্মকর্তারা জানান, তিন হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার (কিমি) আয়তনের ভোলা জেলাকে মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করেছে তেঁতুলিয়া নদী। ২০ লাখের বেশি মানুষ এই দ্বীপে বাস করে। বর্তমানে শুধু নদীপথেই ভোলা যেতে হয়। ৪.৮ কিমির সংযোগ সড়ক ও ৪.৭ কিমি দৈর্ঘ্যরে প্রস্তাবিত সেতুটি নির্মাণের উদ্দেশ্য ভোলার সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করা। তা ছাড়া এই সেতুর সঙ্গে ভোলায় উত্তোলন করা গ্যাস মূল ভূখণ্ডে আনতে পাইপলাইন নির্মাণ করা সম্ভব হবে। ভোলার শাহবাজপুর গ্যাসফিল্ডে ৭২১ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ) গ্যাস মজুত রয়েছে জানা গেছে।
দ্বিতীয় ঋণ প্রস্তাবটি হলো বাকেরগঞ্জ-বাউফল সড়কে কারখানা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ। এই প্রকল্পে ব্যয় হবে তিন হাজার ৪৮ কোটি টাকা (৩৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার)। ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন হয়েছে। বাকেরগঞ্জ ও বাউফল উপজেলা দিয়ে প্রস্তাবিত সেতুটি বরিশাল ও পটুয়াখালীর মধ্যে সরাসরি সড়ক সংযোগ স্থাপন করবে। 
এ ছাড়া ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটে মেঘনা নদীতে ৯.২০ কিমির সেতু নির্মাণেও এনডিবির ঋণ চাওয়া হয়েছে। এই সেতু নির্মাণের লক্ষ্যে প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ চলমান আছে। সেতু বিভাগের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, এই প্রকল্পে ৩৭ হাজার কোটি টাকা (৩৩৬ কোটি ডলার) ব্যয় হতে পারে। 
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ সড়ক সংযোগ স্থাপনে পদ্মা নদীতে ৬ কিমি দৈর্ঘ্যরে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, এ সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ৩১ হাজার ২০০ কোটি টাকা (২৮০ কোটি ডলার)। 
তা ছাড়া এনডিবির কাছে মহেশখালী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত টানেল বা সেতু নির্মাণের অর্থায়ন চায় সরকার। দুই কিমি দৈর্ঘ্যরে এ টানেল বা সেতু নির্মাণে অনুমানিক আট হাজার ১০০ কোটি টাকা বা ৭৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার ব্যয় হতে পারে বলে ধারণা করছে সেতু বিভাগ।
অন্যান্য ঋণ প্রস্তাব ॥ ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, এনডিবির সঙ্গে সেতু বিভাগ ছাড়াও বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো এনডিবির অর্থায়নের জন্য প্রকল্প তালিকা দিয়েছে।

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যায়, সব মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার ৩০০ কোটি ডলারের প্রকল্প তালিকায় পাওয়া গেছে। তবে এনডিবির চূড়ান্ত সম্মতি পাওয়া যাবে প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) পাঠানোর পর। তার আগে সরকার কোন্ কোন্ প্রকল্পে এনডিবির কাছ থেকে ঋণ নেবে, তা নির্ধারণ করবে। পরবর্তীতে ইআরডির মাধ্যমে সে সব প্রকল্পের ঋণ প্রস্তাব এনডিবির কাছে পিডিপিপি পাঠানো হবে।
বিদ্যুতের ১৭ প্রকল্প ॥ বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে ১৭ প্রকল্পে অর্থায়নে জন্য এনডিবির কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে ইআরডি সূত্রে জানা গেছে। এরমধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাঁচটি প্রকল্প এবং বিতরণ ব্যবস্থা ও সঞ্চালনের পাঁচটি প্রকল্প রয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা (৩৭২ কোটি ৭০ লাখ ডলার)। এরমধ্যে ৩২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা (২৯১ কোটি ১০ লাখ ডলার) বৈদেশিক ঋণ থেকে জোগান দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, এনডিবি যে ধরণের প্রকল্পে অর্থায়ন করতে আগ্রহী, তার ওপর ভিত্তি করে তাদের কাছে তালিকা দেওয়া হয়েছে। যেমন নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে তাদের তহবিল আছে। সে কারণে আমরা এ খাতের কিছু প্রকল্প রেখেছি।
বিদ্যুত বিভাগ ছাড়াও সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে ১০টি প্রকল্পে ঋণ চাওয়া হয়েছে। তবে এনডিবির কাছে দেওয়া তালিকায় প্রকল্পের ব্যয় উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় দুটি প্রকল্পে, রেলপথ মন্ত্রণালয় আটটি প্রকল্পে, ঢাকা ওয়াসা পাঁচটি প্রকল্পে এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ তিনটি প্রকল্পে ঋণ চেয়েছে।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, এ বছরে দুটি প্রকল্পে ৭৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারের ঋণ চুক্তি হতে পারে। এরমধ্যে রয়েছে ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহ প্রকল্প। এই প্রকল্পে এনডিবি ঋণ দেবে ৩২ কোটি মিলিয়ন ডলার। ঋণের ওপর ৭ বছরের গ্রেস পিরিয়ড সুবিধা থাকবে। প্রকল্পটি ইতোমধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পেয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে এই প্রকল্পে ঋণ চুক্তি হওয়ার আশা করা হচ্ছে। 
তিতাস গ্যাসের কয়েক দশক পুরোনো লিকেজ ধরা পাইপলাইন প্রতিস্থাপনে ৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার ঋণ দেবে এনডিবি। ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড এই বছরের মধ্যে প্রকল্পটির জন্য এনডিবির সাথে একটি ঋণ চুক্তি চূড়ান্ত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। 
এনডিবি ছয়টি খাতে সদস্য দেশগুলোকে ঋণ দেয়। এগুলো হলো- পরিচ্ছন্ন জ্বালানি ও জ্বালানি ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি, পরিবহন, অবকাঠামো, পানি ও স্যানিটেশন, পরিবেশ সুরক্ষা, সামাজিক অবকাঠামো এবং ডিজিটাল অবকাঠামো খাত।
এনডিবিতে বাংলাদেশ ॥ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এনডিবির সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ, তবে ঋণ প্রস্তাব পাঠাতে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এই সংস্থার কাছ থেকে এখনো ঋণ পায়নি বাংলাদেশ। তবে দুই প্রকল্পে ঋণ প্রক্রিয়াকরণের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।  
সদস্য পদ পাওয়ার পর থেকে ঋণ প্রস্তাব চেয়ে ইআরডির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে চিঠি দেয় এনডিবি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বিশ্ব পরিস্থিতিতে দ্য সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং (সোফর) রেট বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ বাজার-ভিত্তিক ঋণ কম নিচ্ছে। এ কারণে সরকার এনডিবি থেকে ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়ায় ধীরে এগোচ্ছে বলে জানান ইআরডির কর্মকর্তারা।
তবে অবকাঠামো উন্নয়নে আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ সুবিধা দিতে চায় এনডিবি। অবশ্য বাংলাদেশের প্রস্তুতির ওপর ভিত্তি করে, ঋণের পরিমাণ আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।

×