
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবসরের টাকায় করের বোঝা চাপিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবসরের টাকায় করের বোঝা চাপিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বেসরকারি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের মতো উৎস কর ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে সংস্থাটি। এতে বেকায়দায় পড়েছে আর্থিক সংকটে থাকা অবসর সুবিধা বোর্ড। করের চাপে বোর্ডকে প্রতি বছর ১৩ কোটি টাকার বেশি দিতে হবে এনবিআরকে। ফলে এমপিওভুক্ত লাখো শিক্ষক পড়বেন সীমাহীন ভোগান্তিতে।
অবসর বোর্ডের আর্থিক সংকটে চাকরি জীবন শেষ হওয়ার তিন বছর পর অবসর ভাতা পান শিক্ষকরা। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের ছয়ভাগ কর্তন অবসরভোগীদের অর্থ পরিশোধের উৎস, যা দিয়ে বিশাল চাহিদা মেটানো যায় না। সংকট কাটাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫০০ কোটি টাকা (সিড মানি) দিয়েছিলেন। যার এফডিআর থেকে মেটানো হয় শিক্ষকদের অবসরের টাকা। তবে সেবামূলক এই বোর্ডেও বেসরকারি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের মতো উৎস কর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, লাভের টাকা দিয়ে শিক্ষকদের সংকট মোকাবিলা করা হয়। এমন সিদ্ধান্তে শিক্ষকদের অবসরের পর টাকা পেতে আরও বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে।
চাকরি জীবন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবসর সুবিধা পান সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা। কেউ এককালীন, কেউ আবার বছর বছর সুবিধা নেন। তবে ব্যতিক্রম বেসরকারি পর্যায়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে। অবসরের পর এসব শিক্ষককে দুই ধাপে টাকা নিতে হয়। এর একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট, অন্যটি অবসর সুবিধা বোর্ড। এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে অবসর সুবিধা নিতে লেগে যায় তিন বছরের বেশি সময়। অনেক শিক্ষক অবসর সুবিধার টাকা জীবদ্দশায় পান না। এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি রয়েছে। রাজধানীর নীলক্ষেতের ব্যানবেইস অফিসের নিচ তলায় শত শত বৃদ্ধ শিক্ষক প্রতিদিনই টাকার জন্য ভিড় জমান।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অবসর সুবিধা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ৩৪ হাজার শিক্ষক এখনো অবসর ভাতার অপেক্ষায় আছেন। এসব শিক্ষকের টাকা পরিশোধ করতে প্রয়োজন ৪ হাজার কোটি টাকা। প্রতি মাসে আবেদন ও টাকার পরিমাণ বাড়ছে। মাসে গড়ে এই বোর্ডে ৯০০টির বেশি আবেদন জমা পড়ে। অবসরের এই আবেদন নিষ্পত্তি করতে মাসে প্রয়োজন ১০৬ কোটি টাকা। শিক্ষকদের এমপিও কর্তন থেকে জমা পড়ে ৭০ কোটি টাকা। আর প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সিড মানি ও ব্যাংকে রাখা এফডিআরের লভ্যাংশ আসে ৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতি মাসে ৩৩ কোটি টাকার বেশি ঘাটতি থাকে। একইভাবে বছর হিসাবে দেখা যায়, প্রতি বছর আবেদন সংখ্যা ১০ হাজার ৮০০টি। এই আবেদন যারা করেছেন তাদের অর্থ পরিশোধ করতে প্রয়োজন ১২শ’ ৭২ কোটি টাকা। এমপিওর ছয়ভাগ টাকা থেকে আয় হয় ৮৪০ কোটি টাকা। বছরে এফডিআর থেকে লভ্যাংশ আসে ৩৬ কোটি টাকা। এরপরও প্রতি বছর ঘাটতি থাকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রধানমন্ত্রীর এককালীন ৫০০ কোটি টাকা ছাড়াও অল্প কিছু টাকা ছিল বোর্ডের। সেই অর্থ ও সিড মানির পরিমাণ বেড়ে এখন ৬৭০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর ব্যাংক থেকে সাড়ে সাত শতাংশ লাভ পায় বোর্ড। এই আয় থেকে আগে ১০ শতাংশ উৎস কর এনবিআরকে দিতে হতো। কিন্তু এখন তা আরও ২০ শতাংশ বাড়াতে চাইছে এনবিআর। এতে প্রতি বছর ১৩ কোটি টাকার বেশি উৎস কর তাদেরকে দিতে হবে। অথচ এই বাড়তি টাকা দিয়ে শত শত শিক্ষকের অবসরের টাকা মেটানো সম্ভব হতো।
এ বিষয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের সচিব শরীফ আহমদ সাদী জনকণ্ঠকে বলেন, অবসর সুবিধা বোর্ড কোনো কোম্পানি বা লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের সারাজীবন চাকরি শেষে এককালীন অর্থ বোর্ড থেকে দেওয়া হয়। এরপরও যদি এখান থেকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানের জন্য করের বোঝা চাপায়, তা দুঃখজনক। এ বিষয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে তাদেরকে আমরা চিঠি দিয়েছি। তবে এখন পর্যন্ত কোনো জবাব আসেনি।
কর নীতিতে যা আছে ॥ রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে সেকশন ৭৫-এর সাবসেকশন (২) প্রতিস্থাপনের কথা বলা হয়েছে। সেখানে স্বীকৃত ভবিষ্য তহবিল, অনুমোদিত গ্র্যাচুইটি তহবিল, পেনশন তহবিল ও অনুমোদিত বার্ধক্য তহবিলে রিটার্ন বাধ্যতামূলক নয়। ইনকাম ট্যাক্স অডিন্যান্স-১৯৮৪ এর সেকশন ২ এর (৪৬) এ ব্যক্তি হিসেবে যা বলা হয়েছে, এটিও তার সাংঘর্ষিক। কোম্পানি আইন-১৯৯৪ এর ১৮ নম্বর আইনে সংজ্ঞাতেও স্পষ্ট করা হয়েছে। সঞ্চয়ী আমানতের ক্ষেত্রে কর কর্তনের বিষয়ে কোম্পানির জন্য ২০ ভাগ ও কোম্পানি ব্যতীত অন্যদের জন্য ১০ শতাংশ কর কর্তনের হার রয়েছে। সেক্ষেত্রে ৩০ ভাগ উৎস কর আরোপ যথাযথ নয়।
জানতে চাইলে এনবিআর পরিচালক (জনসংযোগ) সৈয়দ এ মুমেন বলেন, আমার কাছে জানানোর মতো কোনো তথ্য নেই। এ বিষয়ে কাজ করে পলিসি শাখা। সেখানে যোগাযোগ করা হলে বিস্তারিত জানতে পারবেন। পরে পলিসি শাখার যুগ্ম কমিশনার মহিদুল ইসলাম চৌধুরীকে একাধিকবার কল ও এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সনের ২৭নং আইনের ধারা-১৫তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণাধীন ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড’ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের সকল এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনের ছয় শতাংশ চাঁদা কর্তন করে অবসর ভাতা প্রদান করা হয়। প্রাপ্ত এই চাঁদার আয় দিয়ে সম্পূর্ণ অবসর ভাতা প্রদান করা যায় না। তাই বর্তমানে ঘাটতির পরিমাণ বিশাল।
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠিয়েছে অবসর সুবিধা বোর্ড। চিঠিতে অবসর সুবিধা বোর্ডকে কোম্পানি আইনের বাইরে রেখে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়ে উৎস করমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে করের বোঝায় শিক্ষকদের দুর্ভোগের বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) এ কে এম আফতাব হোসেন প্রামাণিক জনকণ্ঠকে বলেন, অবসর সুবিধা বোর্ড এমনিতেই তিন বছর ব্যাকলকে আছে। এ অচলাবস্থা কাটাতে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। তবে এনবিআরের চিঠি বা উৎস কর বৃদ্ধির বিষয়টি আমরা জানি না। শিক্ষকদের টাকা এভাবে যদি নেওয়া হয়, তাহলে এনবিআরকে জানাতে বা বোঝাতে হবে। এ বিষয়ে অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।