ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিচার চাইলেন বিষক্রিয়ায় নিহত ২ শিশুর বাবা

প্রকাশিত: ১৯:২৮, ৮ জুন ২০২৩

বিচার চাইলেন বিষক্রিয়ায় নিহত ২ শিশুর বাবা

নিহত ২ শিশু

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তেলাপোকা মারার স্প্রের বিষক্রিয়ায় ২ শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেড কোম্পানির চেয়ারম্যান আশরাফুজ্জামান এবং কোম্পানিটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ফরহাদুল আমিনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

বৃহস্পতিবার (৮ জুন) গ্রেফতারের পর দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ সময় দুই শিশুর বাবা মোবারত হোসেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের মোবাইলে ভিডিও কলে ফোন দেন। পরে তিনি সন্তান হত্যার বিচার দাবি করেন।

তিনি বলেন, আমার দুই ছেলে মেহমান হিসেবে আমাদের কাছে এসেছিল। কিন্তু আমি শুধু এটুকু বলতে চাই। যে প্রতিষ্ঠান ও মালিকের কারণে আমার বাসায় এই মেডিসিন প্রয়োগ করা হয়েছে। তাদের বিচার চাই। 

মোবারত হোসেন বলেন, আমার যখনই বিশেষজ্ঞকে নিয়ে আসি। যখন কোনো ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হই না। তখনই তাদের আনা হয়। পরে তাদের টাকার বিনিময়ে কাজ করে দেন। এ কারণে পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিসে লোকদের আমার বাসায় এনেছিলাম। আমার সাথে তাদের কি কথা হয়েছে; আপনারা চাইলে সেগুলো বের করতে পারেন। আমার কাছে কিছু ডুকুমেন্ট আছে। সেগুলো গোয়েন্দা প্রধানের কাছে হস্তান্তর করব।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ওরা যেন কোনোভাবে পার না পায়। তাদের শান্তি অবশ্যই হতে হবে। 

সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনার আইনশৃঙ্খলাকারী বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা করবেন। তারা যেন সুন্দরভাবে তথ্য সংগ্রহ করে। তারা জড়িতরা যেন কোনোভাবেই পার না পায়, এটাই আমার দাবি।
 
তিনি বলেন, আমার ২ সন্তান হারানোর পর জানতে পারি, এই মেডিসিনটা বাসা-বাড়ির জন্য নয়। এগুলো বিভিন্ন গার্মেন্সে ব্যবহার করা হয়।  মোবারত হোসেন বলেন, আমার সন্তানদের জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন তাদের বেহেস্ত দান করেন।

এছাড়াও তার মেয়ের জন্য দোয়া চেয়ে তিনি বলেন, আমার মেয়ে এখনো পুরোপুরি সুস্থ্য হয়নি। মেয়ের জন্যও দোয়া করবেন। এর আগে মারা যাওয়া দুই শিশুর বাবা মোবারত হোসেন বাদী হয়ে দ্য পেস্ট কন্ট্রোল নামের ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেন। মোবারতের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে। তিনি ঢাকা রয়েল ক্লাব লিমিটেডের (উত্তরা) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এ ঘটনায় গত সোমবার রাতে বালাইনাশক কোম্পানির টিটু মোল্যা নামের এক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি বাসাটিতে কীটনাশক প্রয়োগ করেছিলেন।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত শুক্রবার পোকামাকড় নিধনে একটি পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বাসায় ডেকে আনেন মোবারত হোসেন। কীটনাশক স্প্রে করার পর কর্মীরা বলে যান, ছয় ঘণ্টা যেন কেউ বাসায় না ঢোকেন। এরপর পুরো বাসা পরিষ্কার করে বসবাস করতে হবে। পরিবারটি বাইরে সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অসুস্থ হয়ে পড়ে ছোট ছেলে শাহির মোবারত জায়ান (৯)। এরপর অসুস্থ হয়ে পড়ে তার বড় ভাই শায়ান মোবারত জাহিন (১৫)। রবিবার ভোরে দুই ভাইকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শাহিরকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শায়ানও মারা যায়।

শিশু দুটির স্বজনরা অভিযোগ করেন, পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিসের অদক্ষ কর্মীদের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।

এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে বালাইনাশক পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানির এমডি আশরাফ ও চেয়ারম্যান ফরহাদকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তেলাপোকা মারার স্প্রের বিষাক্তক্রিয়ায় ১ কিশোর এবং তার ছোট ভাইয়ের অকাল মৃত্যু ঘটে। 

এ বিষয়ে রাজধানীর ভাটারা থানায় গত ৫ জুন একটি নিয়মিত মামলা হয়। ঘটনার পর থেকেই মূল আসামি ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেড কোম্পানির চেয়ারম্যান আশরাফুজ্জামান এবং কোম্পানিটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ফরহাদুল আমিন গা ঢাকা দেন। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা টের পেয়ে আসামিরা তাদের নিজস্ব গাড়িতে টাঙ্গাইল, নরসিংদী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে থাকেন। সে কারণে তাদের ধরা সম্ভব হচ্ছিল না।

ডিবি প্রধান বলেন, ফুটফুটে ও সুস্থ দুই সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা-বাবার কষ্ট উপলব্ধি করে প্রকৃত আসামিদের গ্রেফতারের জন্য মাঠে নামে গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ। ভাটারা থানা পুলিশের সহযোগিতায় আসামিদের ভ্রাম্যমাণ অবস্থান শনাক্ত করে বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৮টার দিকে নরসিংদী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সীমান্ত এলাকা থেকে গাড়িসহ তাদের গ্রেফতার করে গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের কোতোযালি জোনাল টিমের সদস্যরা। এই গাড়িতে করেই আসামিরা ক্রমাগত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিচ্ছিল।

পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, তীব্র দাবদাহে এমনিতেই জনজীবন অতিষ্ঠ প্রায়। শ্বাসকষ্টসহ নানা রকমের শারীরিক সমস্যাতে কাহিল শিশু এবং বৃদ্ধরা। তেলাপোকাসহ অন্যান্য কীটনাশক মানবজীবনের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, বিশেষত তীব্র দাবদাহের এই সময়ে বিষয়টি উপলব্ধি করা দরকার ছিল পেস্টিসাইড কোম্পানির কর্মকর্তাদের। কিন্তু অর্থের লোভে কোম্পানির মালিক কর্মচারীরা স্বাস্থ্যঝুঁকির এই বিষয়টিকে উপলব্ধি না করে এবং পরিবারের সদস্যদের যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উপদেশ না দিয়েই আনাড়ি কর্মচারীদের দিয়ে এই কীটনাশক স্প্রে করেছে, যার ফলে দুটি শিশুর জীবন ঝরে যায় অকালে। অসুস্থ হয়ে পড়ে পরিবারের অন্য সদস্যরাও।

এমএস

×