ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

কৌশল চূড়ান্ত করছে আওয়ামী লীগ

নতজানু নীতি নয় ॥ মার্কিন ভিসানীতি

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ২৯ মে ২০২৩

নতজানু নীতি নয় ॥ মার্কিন ভিসানীতি

অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসানীতি

অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসানীতি দেশে নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। প্রকাশ্য এই ভিসানীতি নিয়ে চাপে থাকার বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও ভেতরে ভেতরে হঠাৎ করে সামনে আসা আগামীদিনের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কৌশল ও কর্মসূচি ঠিক করতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতজানু না হয়ে ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়েছে আওয়ামী লীগ। 
গাজীপুরের মতো আসন্ন চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন, বিএনপির সম্ভাব্য আন্দোলন কৌশলে মোকাবেলা, ভিসানীতির আলোকে আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পাদনসহ বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ এসেছে ক্ষমতাসীন দলটির সামনে। গত টানা ১৪ বছরে দেশের ব্যাপক উন্নয়ন ও অগ্রগতি এনে ভোটের মাঠে জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটারে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলো থেকে অনেক এগিয়ে থাকলেও আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর না তুলে বরং সামনে আসা এসব চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবেলা করা যায়, তা নিয়ে দলটির নীতিনির্ধারক পর্যায়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে।

শীঘ্রই আওয়ামী লীগ দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক ডেকে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা শেষে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কৌশল চূড়ান্ত করবে বলে জানা গেছে। গত ২৪ মে ঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য দায়ী বা এ রকম চেষ্টা করেছেন বলে প্রতীয়মান হলে ওই ব্যক্তিকে ভিসা দেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র। 

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দল নতজানু হবে না। কূটনৈতিক তৎপরতা, বিশেষ করে মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি জোরদারের চেষ্টা চলছে। এছাড়া নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশে বিভ্রান্তি ছড়ানোর পাশাপাশি নানা উস্কানি দিয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে অশান্ত ও সংঘাতময় করার ষড়যন্ত্র চলছে। এ ব্যাপারে রাজপথে যথেষ্ট সতর্ক ও কৌশলী অবস্থান নেবে আওয়ামী লীগ। আগ বাড়িয়ে কোনো ধরনের সংঘাত বা সহিংসতায় জড়াবে না দলের নেতাকর্মীরা। তবে গায়ে পড়ে আঘাত করা হলে, দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হলে সেক্ষেত্রে বসে থাকবে না আওয়ামী লীগ।
এ ব্যাপারে সোমবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিদেশী প্রভুদেরকে তুষ্ট করার জন্য বিএনপি মিলিয়ন ডলার খরচ করে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছে। তাদের সেই ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত। বিদেশী প্রভুদের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে তারা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির আলোকে সরকার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে নতুন নতুন নাটক সাজিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। নানাস্থানে নিজেরাই মারামারি করে আহত হয়ে তার দোষ চাপাচ্ছে সরকারের ওপর। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতির কারণে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের ষড়যন্ত্র ভেস্তে গেছে। একই সঙ্গে নির্বাচন বানচালে বিএনপির আগুন সন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কতা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে বিএনপি এখন গভীর হতাশায় নিমজ্জিত।
আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি লাগাতার কর্মসূচি দিয়ে আসছে। তারা সরকার পতন ছাড়া ঘরে না ফেরারও ঘোষণা দিয়েছে। সংঘাত-সহিংসতায় উস্কানি দিতে ইতোমধ্যে বিএনপি নানা স্থানে আওয়ামী লীগের ওপর হামলাও চালিয়েছে। ফলে এই আন্দোলন মোকাবেলার কোন্ পথে এগুবে ক্ষমতাসীনরা তা নিয়েও দলটির নীতিনির্ধারক ফোরামে আলোচনা চলছে। প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে, নির্বাচন পর্যন্ত মাঠে থাকলেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে নিজেরা কোনো সংঘাতে জড়াবে না আওয়ামী লীগ। নির্বাচনী পরিবেশ নষ্টের কোনো অজুহাত বিশ্বের সামনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা যাতে তুলতে না পারে সেজন্য ইতোমধ্যে সর্বোচ্চ সংযম ও ধৈর্যধারণ করার জন্য তৃণমূল নেতাদের কাছে বিশেষ বার্তাও পাঠিয়েছে আওয়ামী লীগ।
আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে দলের প্রার্থীর পরাজয় ঘটলেও এ নির্বাচনে ন্যূনতম প্রভাব খাটাতে যায়নি ক্ষমতাসীনরা। বরং সাম্প্রতিক সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান উপহার দিয়ে উল্টো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেই চাপে ফেলতে সক্ষম হয়েছে আওয়ামী লীগ। 
সামনে আরও চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গাজীপুরের মতো এই চারটি নির্বাচনও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনের একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায় দলটি। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অবস্থান হচ্ছে, দলের মধ্যে সৃষ্ট অনৈক্য এবং বিএনপি-জামায়াতের সম্মিলিত ভোট দলের বিদ্রোহী প্রার্থীকে জেতাতে সহায়তা করলেও সামনের চারটি সিটি নির্বাচন নিয়ে খুবই সতর্ক থাকবে তারা। নির্বাচনে কোনো ধরনের প্রভাব খাটানো থেকে বিরত থাকলেও চারটি নির্বাচনী এলাকায় দলের অনৈক্যের কারণে নৌকার প্রার্থীরা যেন পরাজিত না হয় সেজন্য পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে ক্ষমতাসীনরা। 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুরের মতো বাকি চারটি সিটি নির্বাচনও শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিসহ তাদের মিত্রদের চাপে ফেলতে চায় আওয়ামী লীগ। এসব নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা নির্বাচন বর্জনের মতো কোনো প্রামাণিক দলিল বিশ্ব মোড়লদের সামনে তুলতে পারবে না। আর বিশ্বের কোনো মোড়লই বিএনপির দাবি- তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে একটি কথাও তোলেনি। ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচন বিএনপি ও তাদের মিত্ররা বর্জন করলে কিংবা অতীতের মতো নির্বাচন বানচাল করতে অগ্নিসন্ত্রাস, নাশকতা কিংবা ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের দিকে ধাবিত হলে সেক্ষেত্রে বিএনপিই রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হবে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কৌশল চূড়ান্ত করছে আওয়ামী লীগ।
তবে কিছু বিষয়ে আওয়ামী লীগ চিন্তিত থাকলেও দলটির নেতারা বলছেন, তারা বিএনপির আন্দোলন নিয়ে মোটেই ভীত নয়। জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে আওয়ামী লীগ। পরিস্থিতি অনুকূলে রাখতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েই মাঠে থাকার কথা ভাবছে তারা। সরকারে থাকার কারণে আওয়ামী লীগ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের পথে যেতে চায় না। তবে রাজপথ আগামী নির্বাচন পর্যন্ত দখলে রাখতে টানা নানা কর্মসূচির মাধ্যমে মাঠে সরব থাকার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। 

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের একাধিক নীতিনির্ধারক নেতা জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি দিয়েছে, তাতে বিএনপি নির্বাচনে না এসে সন্ত্রাসের পথ বেছে নিলে উল্টো তারাই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে। এ কারণে মুখে যাই-ই বলুক, সংবিধান মেনেই আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া বিকল্প পথ নেই। আর তাই মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ কিছু ভাবছে না। কারণ আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে চায়। ফলে যারা নির্বাচন ভ-ুল করতে চায়, দেশে সংঘাত, জঙ্গিবাদ করতে চায়- তারাই মার্কিন ভিসানীতির আওতায় আসবে। 
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কূটনৈতিক অভিজ্ঞরা বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তারা দলটির নানা বৈঠকে অংশ নিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক যতটা খারাপের কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে তা ঠিক নয়। তারা দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক সেটাই চাইছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ চাওয়ার সঙ্গে দ্বিমত করেননি। আর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও বিশ্বের মোড়ল অনেক দেশই পক্ষে ছিল না। কিন্তু সফল কূটনৈতিক দক্ষতা ও সাহসের ওপর বলিয়ান হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই দুটি নির্বাচন করে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়ক দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তেমন কূটনৈতিক চাপ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা সরকারের রয়েছে। সুতরাং নির্বাচন পর্যন্ত নিজের দেখানো পথেই চলবে সরকার। তবে কোনো পাতা ফাঁদে পা দেবে না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক নেতার অভিমত, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি শুধু সরকারের ওপরই চাপ নয়, এ নীতি বিএনপির জন্যও বুমেরাং হয়ে গেছে। কারণ তারা সরকার পতনের জন্য এক দফার আন্দোলন করছে। ভিসানীতির কারণে এক দফার আন্দোলন চলে না। তারা নির্বাচন করতে দেবে না। কিন্তু অবাধ ও শান্তিপূর্ণ একটি নির্বাচন হবে, সেখানে তাদের অংশগ্রহণ করতেই হবে। আর আওয়ামী লীগ সব সময়ই চায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে দেশ চলুক। যেসব দল আমাদের বিরোধিতা করছে, তারা আগামী নির্বাচনে আমাদের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না। 
এ প্রসঙ্গে সোমবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, মার্কিস ভিসানীতি বিএনপির জন্যই বড় চাপ তৈরি করেছে। কারণ এই ভিসানীতির কারণে এখন আর নির্বাচন প্রতিহত করব, সেটি বলার সুযোগ নেই বিএনপির। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে নির্বাচনকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তারা বলেছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই, একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক সেটিই তারা চায়। অর্থাৎ বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তাদের সমর্থন পায়নি, বিশ্বব্যাপী কারো সমর্থন পায়নি। তাই বিএনপির অন্তত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটি নিয়ে আর কথা বলার সুযোগ নেই। ফলে এই ভিসানীতি তাদের ওপর বিরাট চাপ তৈরি করেছে।

×