ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারি হাসপাতালে না পেয়ে ফার্মেসি থেকে বেশি দামে কিনতে হয় রোগীদের

বিনামূল্যের ওষুধ খোলাবাজারে

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ০০:০০, ২৯ নভেম্বর ২০২২

বিনামূল্যের ওষুধ খোলাবাজারে

ওষুধের গায়ে লেখা ‘সরকারি সম্পদ বিক্রি করা দণ্ডনীয় অপরাধ

ওষুধের গায়ে লেখা ‘সরকারি সম্পদ বিক্রি করা দণ্ডনীয় অপরাধ’। কিন্তু এগুলো দেদার বিক্রি হচ্ছে খোলাবাজারে। শুধু দেশের খোলাবাজারেই নয়, পাওয়া গেছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বাজারেও। এমন ঘটনায় বিস্মিত স্বাস্থ্য বিভাগও। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি বন্ধে নেই কার্যকরী কোনো তদারকি। বরং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকলেও চাহিদামাফিক সরকারি এসব ওষুধ না পাওয়ায় পার্শ্ববর্তী ফার্মেসিগুলো থেকে উচ্চমূল্যে কিনতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। বিশেষ করে জরুরি চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিকগুলো উচ্চ মূল্যে কিনতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন কিশোরী স্মিতা রায় (ছদ্মনাম)। ডাক্তার তাকে এজিথ্রোমাইসিন ৫০০ এমজি সেবনের পরামর্শ দিয়েছেন দিনে তিন বেলা। এসেনসিয়াল ড্রাগের তৈরি এই ওষুধটি নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সরবরাহ করার কথা থাকলেও তা না পেয়ে পার্শ্ববর্তী স্টার ফার্মেসিতে ওষুধটি কিনতে এসেছেন স্মিতার ভাই উচ্ছ্বাস। সরকারি ওষুধ হাসপাতাল থেকে দিচ্ছে না অভিযোগ করে তিনি বলেন, প্যারাসিটামল ছাড়া আর বিশেষ কোনো ওষুধ হাসপাতাল থেকে পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়েই কিনতে এসেছেন।
শুধু এজিথ্রোমাইসিনই নয় সর্দিকাশির চিকিৎসায় ব্যবহৃত, সেট্রিয়াক্সিন, ওমিপ্রাজলের মতো জরুরি ওষুধ অবাধে বিক্রি হচ্ছে খোলাবাজারে। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে রোগীদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য দেওয়ার কথা থাকলেও সেগুলো পাওয়া যাচ্ছে হাসপাতালগুলোর সামনের ফার্মেসি ও বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে। এতে  দেশের বেশিরভাগ দরিদ্র মানুষ যেমন সরকারি ওষুধ পাচ্ছে না, তেমনি স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।  
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের ওষুধ বাইরে বিক্রি হলেও শেরেবাংলা নগর এলাকাতেই এই প্রবণতা বেশি। হাসপাতাল পাড়া হিসেবে পরিচিত এই এলাকায় রয়েছে অনেকগুলো সরকারি হাসপাতালসহ প্রচুর বেসরকারি ক্লিনিক। সরকারি হাসপাতালগুলোর নি¤œপদস্থ কর্মীরা গোপনে বেসরকারি হাসপাতাল বা ফার্মেসিগুলোতে সরকারি ওষুধ বিক্রি করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

এই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সময়ের অভিযানেও। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, গত এক বছরে সরকারি ওষুধ খোলাবাজারে বিক্রি করার দায়ে দেশজুড়ে ১৬টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত: ৩১ জনকে। সম্প্রতি এরকম একটি অভিযানে আমরা সাড়ে ৩ হাজার পিস এজিথ্রোমাইসিন ৫০০ এমজি ট্যাবলেট জব্দ করেছি।

একই সঙ্গে জব্দ করা হয়েছে সেট্রিয়াক্সিন ইঞ্জেকশনও প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পিস। একই দিন জব্দ করা হয় ১৩ হাজার পিস ফেক্সোফাস্টও।  সব মিলিয়ে মোট ১৬ হাজার ৫০০পিস ট্যাবলেট ও ৩ হাজার ২শ’ পিস ইঞ্জেকশন জব্দ করা হয়েছে। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় দুইজনকে। ঠিক কি অভিযোগের ভিত্তিতে এই অভিযান পরিচালনা করেছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমরা জানতে পেরেছিলাম আসামিরা উৎপাদিত সরকারি ওষুধ দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করত এবং তা সারাদেশে বিক্রি করত। তারা প্রায় ৩ বছর যাবত ভেজাল এবং সরকারি ওষুধের কারবার করে আসছিল।  
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের একমাত্র সরকারি ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) ১৩৭টি আইটেমের ওষুধ তৈরি করে। প্রতিবছর দেশের সরকারি হাসপাতালসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে চাহিদার প্রায় ৭২ শতাংশ ওষুধ সরবরাহ করে ইডিসিএল। সরকার এখানে বিনিয়োগ করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে জনসাধারণকে বিনামূল্যে সরবরাহ করার জন্য। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী হাসপাতালের সেই ওষুধ বিক্রি করে দিচ্ছে বাইরে। এতে বঞ্চিত হচ্ছে সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসার জন্য আসা দেশের দরিদ্র মানুষ।
বিষয়টি স্বীকার করেছে খোদ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরও। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ জনকণ্ঠকে বলেন, দেখেন এটা একটা কঠিন সিন্ডিকেট। আমরা প্রতিদিনই রাজধানীর কোনো না কোনো জায়গায় অভিযান পরিচালনা করি। প্রতিদিনই নকল ওষুধ, সরকারি ওষুধ, মানহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ জব্দ করি। সরকারি ওষুধ খোলাবাজারে বিক্রির ফলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ওষুধের প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে।

এতে করে চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা কমে যাচ্ছে। পুলিশের পাশাপাশি আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। তবে আমাদের ফার্মেসি ব্যবসায়ীরা এতটা সচেতন না। সাধারণ মানুষ তো না-ই। ফলে সরকারি ওষুধ ফার্মেসিতে ক্রয়-বিক্রয় সম্ভব হচ্ছে। এক্ষেত্রে আরও কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।
সরকারি ওষুধ বাইরে বিক্রি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা অনুমোদনহীন ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি। এটি দৃশ্যমান। ভেজাল ওষুধ বিক্রি বন্ধেও যথেষ্ট নজরদারি করা হচ্ছে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের ওষুধ খোলাবাজারে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা একটু কঠিন।

কারণ এর পেছনে আমাদের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর অর্থনৈতিক দুবর্লতা, অবহেলা এবং অনৈতিকতাই দায়ী। আমরা অনেক সময়েই দেখি, সরকারি হাসপাতাল থেকে ওষুধ পাচারকালে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছেন, তারপরও সেটি বন্ধ হচ্ছে না। সরকারি ওষুধ দেশের সরকারি হাসপাতালে আসা মানুষদের জন্যই, তাদের আমরা সেগুলো দিতে পারলেই আমাদের স্বাস্থ্যসেবা উন্নত হতো। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আমাদের চেষ্টায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে, আমরা সবাই চেষ্টা করলে, দেশের মানুষ উপকৃত হবে।
শুধু বাংলাদেশের বাজার নয় এমনকি ভারতের হাসপাতালেও মিলেছে বাংলাদেশের সরকারি ওষুধ। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার পূর্ব মেদিনীপুরের একটি হাসপাতালে বাংলাদেশের সরকারি ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে। মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমা হাসপাতালের আউটডোরে চিকিৎসা নেয়া রোগীদের সরকারিভাবে যে ওষুধ দেওয়া হয় সেগুলোর মধ্যে কয়েকটির গায়ে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সম্পদ, ক্রয় বিক্রয় আইনত দণ্ডনীয়’ কথাটি লেখা ছিল।

বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর দুই দেশের প্রশাসনই নড়েচড়ে বসে। ওই হাসপাতালের আউটডোরে চিকিৎসা নেয়া রোগীদের মধ্যে কয়েকজনের ব্যবস্থাপত্রে ডক্সিসাইক্লিন ক্যাপসুল লিখে দেন চিকিৎসক। ওই ব্যবস্থাপত্র  দেখিয়ে হাসপাতালের সরকারি ফার্মেসি থেকে ওষুধ নেন রোগীরা। কিন্তু ওষুধের গায়ে বাংলা হরফে লেখা, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সম্পদ, ক্রয় বিক্রয় আইনত দণ্ডণীয়।’ যা খুবই অনাকাক্সিক্ষত উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, চিকিৎসা সেবা একটি দেশের জনগণের সবচেয়ে জরুরি মৌলিক চাহিদা।

এই চাহিদা পূরণে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এক শ্রেণীর অতি লোভী মানসিকতার কারণে দেশের সুনামের পাশাপাশি হুমকির মধ্যে পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও। এদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া উচিত হবে না। আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত এদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অভিযান পরিচালনা করা।

×