ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আজ বিশ্ব প্রবীণ দিবস

বয়স্কদের ভাবনার জট ছুটছে না 

সমুদ্র হক 

প্রকাশিত: ১৫:২৮, ১ অক্টোবর ২০২২

বয়স্কদের ভাবনার জট ছুটছে না 

প্রবীণ নারী

প্রবীণদের আকুতি নিয়ে আজ বিশ^জুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। প্রবীণদের সম্মান শুভেচ্ছা ও তাদের আন্তরিক ভালবাসা জানাবার দিন। জাতিসংঘ ১৯৯০ সালে প্রতিবছর ১ অক্টোবর প্রবীণ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তী বছর থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবারে পালিত হচ্ছে ৩২তম প্রবীণ দিবস। 

কেমন আছেন বাংলাদেশের ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯ জন প্রবীণ। যাদের বয়স ৬৫ বছরের বেশি তাদেরই প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য হয়েছে ‘পরিবর্তিত বিশে্ব প্রবীণ ব্যক্তির সহনশীলতা’ (ইংরেজীতে রেজিলিয়েন্স অব ওল্ডার পার্সন ইন এ চেঞ্জিং ওয়ার্ল্ড)। প্রবীণদের সুরক্ষা নিশ্চিত ও অধিকারের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ^জুড়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি এই দিবসের অন্যতম লক্ষ্য।

 
চিকিৎসা বিজ্ঞানের কথা \ বয়সের হিসাবে নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করলে প্রবীণের ছাপ চলে আসে। গলায়, চোখের নিচে, হাতে ত্বকের ভাঁজ পড়ে। মনে হবে পুরানো বৃক্ষের ফেটে যাওয়া ছাল-বাকল। বয়স ৭০ অতিক্রম করে আশির দিকে যাওয়ার সময় মনটি হয়ে যায় শিশুদের আচরণের মতো। পরিবারের সদস্যদের ও আপনজনের সামান্য উচ্চবাচ্যে হৃদয়কে ব্যথিত করে তোলে। এইসব ছোট্ট ছোট্ট বেদনা থেকে জন্ম নেয় ভুলে যাওয়া রোগের। যাকে বলা হয় ভুলোমন।     
ভাবনাগুলো জট বাঁধে। জট ছাড়াতে গিয়ে অনেকেই স্মৃতিকে সামনে আনতে পারেন না সহজে। চেনা ও কত পরিচিত ঘটনা রিক্যাপ করতে ব্যর্থ হন। ভাবনার সঙ্গে ভর করে ভাবনাগুলো কাছে নিয়ে পথ চলতে অনেক সময় চেনা পথ হারিয়ে ফেলেন। একজন চিকিৎসক বললেন বার্ধক্যে মানুষের স্ট্রেস (মানকি চাপ) বেড়ে যায়। 

বয়স্করা জীবনের প্রান্ত বেলায় হিসাব-নিকাশ মেলাতে পারেন না। জীবনের চাওয়াপাওয়া প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি সবই এলামেলো হয়ে ভেসে ওঠে। ‘মেমোরি রিকল’ বা স্মৃতিকে টনে আনেন খুব কষ্টে। বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেন না। সাধারণত এই বয়সী মানুষের অনেক কিছুই অতি প্রয়োজনের মুহূর্তে মনে করতে পারেন না। যেমন পরিচিত ও চেনা মানুষের নাম, বাজারে গিয়ে কিছুক্ষণ আগে মনে থাকা পণ্যের নাম, জানা উত্তর ভুলে যাওয়া, কথা বলতে গিয়ে স্মৃতির অধ্যায়ে দৃশ্য ছিটকে পড়া এমন নানা কিছু। 

৬০ বছরের পর থেকেই ধীরে ধীরে মানুষের এমন স্মৃতি বিভ্রাট শুরু হয়ে যায়। তবে এমনটা তীব্র হয় ৬৫ উর্ধকালে। এমন বক্তব্য দিয়েছেন একাধিক বিজ্ঞানী। এই অবস্থায় ভ্রান্তি বিলাস হওয়াও বিচিত্র নয়। কত দিনের চেনা মানুষ, সহপাঠী, কর্মক্ষেত্রের সহকর্মী, পরিচিতমুখ হেঁটে আপনার পাশ দিয়েই চলে গেল। চোখে চোখ পড়ায় মৃদু হাসি বিনিময়ও হলো। অথচ মনে করতে পারলেন না। এমনও হয় দেখা হওয়ার সঙ্গেই দু’জনই প্রথমে কুশলাদি বিনিময় করলেন। ফিরে গিয়েও মনে করতে পারলেন না তিনি কে ছিলেন। বাড়িতে অনেকদিন পর অতিথি এসেছেন, তাৎক্ষণিক চিনতে পারলেন না। 

এমনই ভুলে যাওয়ার সঙ্গে ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে। অনেকে ভুল বোঝে। মনোবিজ্ঞান বলে, মানব মনোজগত এতই জটিল যে কখনও কখনও নিজেকেই বুঝতে পারে না। স্মৃতিভ্রম বিষয়টি মনোজগতের বাইরেও নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্মৃতিভ্রম নিউরনজনিত রোগ। মানব জীবনে স্মৃতির অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে নিউরন প্রক্রিয়া। স্মৃতিভ্রমকে বিজ্ঞানে বলা হয় আলঝেইমার্স বা ডিমনেশিয়া। বাংলা অর্থে স্মৃতি লোপ বা ভুলে যাওয়া রোগ। একজন সাইকো থেরাপিস্ট এক আলোচনায় বলেছেন, বয়স বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে ¯œায়ুকোষ নিউরনের ভেতরে কিছু ফ্রি র‌্যাডিক্যাল জমতে থাকে। যা নিউরন ক্ষতির অন্যতম কারণ। কোষের মেটাবলিজমের পর সৃষ্ট বর্জ্য পদার্থ বয়সের সঙ্গে জমাট বাঁধতে শুরু করে। বয়স ৬০ অতিক্রমেই মস্তিষ্কের ক্ষয় শুরু হয়ে পুরুত্ব কমে যায়। সেরিব্রাল সালকাইগুলো চওড়া হয়। ¯œায়ুর সঙ্কেত সঞ্চালন ক্ষমতা কমে যায়। এই সময় জেনেটিক গুরুত্ব হারিয়ে কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়ে লোপ পেতে থাকে স্মৃতিশক্তি। 

সাধারণত ৮০ বছর বয়সের পর (যদি বেঁচে থাকেন) জেনেটিক ফ্যাক্টর তেমন কাজ করে না।  
বাংলাদেশে ডিমনেশিয়া রোগের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এই রোগাক্রান্তরা চিকিৎসকের কাছে যান না। পরিবারে, পথেঘাটে, কর্মক্ষেত্রে, অনুষ্ঠানে, আলাপচারিতায় নিজে উপলব্ধি করতে পারেন। স্বগোক্তিতে বলা হয়-এই যাহ! কি যে বলতে চাইলাম ভুলে গেছি। কেউ বলেন, বয়স হয়েছে কতই আর মনে থাকে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয় বাংলাদেশে ৬৫ বছরের উর্ধে এই সংখ্যা বেশি। এ সময় ‘স্ট্রেস’ (মানসিক চাপ), বিষণœতা অনেকাংশে বেড়ে যায়। পরিবর্তন ঘটে আচরণের ও ব্যক্তিত্বের। চিকিৎসা বিজ্ঞানে বয়স্কদের চিকিৎসায় আছে ‘জেরিয়াট্রিক মেডিসিন’। দেশে এই ধরনের চিকিৎসা চালু নেই।
 
আমেরিকান একাডেমি অব নিউরোলজির জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় স্মৃতিভ্রম প্রতিরোধে মাছের তেল উপকারী। উচ্চ মাত্রায় মেগা-৩ ফ্যাটি এ্যাসিড থাকায় মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি করে বয়স্কদের স্মৃতিধারণ ক্ষমতা বাড়াতে বড় ভ‚মিকা রাখে। ব্যক্তি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও দেহের যতেœর মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যে নিজের স্মৃতিকে অনেকটা সময় ধরে রাখতে পারেন। তবে বেশি আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। 

মনোবিজ্ঞানীগণ বলছেন, মানব জীবনের একটা পর্যায়ে এমন অবস্থা সকলের হতে পারে (হয়ও)। কারও এমন অবস্থায় অনেকেই হেসে উড়িয়ে দেন। বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। দিলেও তা খুব কম।
 

এসআর

×