অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ
কোরবানির ঈদ আসন্ন। পুরনো ছন্দে আসছে ঈদের আনন্দ। মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে একটি ঈদ-উল-আজহা বা কোরবানির ঈদ। এর আগের বছরে পরপর দুটি কোরবানি ঈদের আনন্দকে নির্জীব করে রেখেছিল করোনা। এবারও শঙ্কামুক্ত হওয়া যায়নি, কারণ করোনার থাবা আবারও হানা দিয়েছে।
করোনা পরিস্থিতিতে এবারের ঈদের আয়োজনে যুক্ত করতে হবে অতিরিক্ত সতর্কতা। আমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের একটি পবিত্র ঈদ-উল-আজহা এবং করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের মধ্যেই আমাদের পবিত্র ঈদ-উল-আজহা পালন করতে হচ্ছে। এদিকে করোনা সংক্রমণ আর মৃত্যু পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। কেবল করোনা নয়, প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও। তাই ঈদ পালনে এবার সর্বোচ্চ সতর্কতা পালন জরুরী। কোনভাবেই যেন আমাদের ঈদ আনন্দ কারও জন্য বেদনা ডেকে না আনে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে করোনা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে জনগণের মাঝে ব্যাপক অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদিও সংক্রমণ বেড়ে চলছে, তবে এখনও হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যা বেশ কম। একটা জিনিস লক্ষ্য করা যাচ্ছে দেশজুড়ে করোনা বাড়লেও জনগণের মাঝে ভয়ভীতি একেবারেই নেই। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে কারও কোন তোয়াক্কাও নেই, সবার মাঝে খামখেয়ালি বা গাছাড়া ভাব। হাসপাতালে রোগী ভর্তি কম বলে পরিস্থিতি হালকাভাবে নেয়া ঠিক হবে না। অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
কারণ করোনার ধরন ওমিক্রনের যে নতুন উপ-ধরন ছড়িয়ে পড়ছে, তা নিয়ে নিশ্চিন্তভাবে কিছুই বলা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি যে কোন সময় খারাপ হতে পারে। জনগণকে অবশ্যই সচেতন এবং সতর্ক থাকতে হবে। প্রশাসনের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা কখনই সম্ভব নয়, যদি না জনগণ নিজেরা নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন।
করোনার সঙ্গে কোরবানির ঈদ ॥
ঈদ হলো আনন্দের উপলক্ষ। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে এবারও কোরবানি ঈদের আমেজ একটু ভিন্ন। আনন্দের মাঝে দেখা দিয়েছে নানা শঙ্কা, জনমনে রয়েছে নানা প্রশ্ন। আমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের একটি পবিত্র ঈদ-উল-আজহা। এই ঈদে পশু কোরবানি দেয়া ধর্মীয় বিধান।
কোরবানির পশু কেনা থেকে শুরু করে পশু জবাই ও খাদ্য গ্রহণের প্রতিটি স্তরে স্বাস্থ্য সতর্কতা মেনে চলা যাবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে নানা বিভ্রান্তি। ধর্মীয় রীতি ও আনন্দ ভাগাভাগি করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি বা স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সম্ভাবনা কমবে এবং করোনাকালেও ঈদকে আনন্দময় করে তোলা যাবে।
এবার সংক্রমণ যদিও বেড়ে চলছে, তবে তা বড় বড় শহরকেন্দ্রিক। গ্রামের অবস্থা কিন্তু অনেকটাই ভাল। তাই সবার কাছেই অনুরোধ রইল, যে যেখানে আছেন, সেখানেই ঈদ করতে চেষ্টা করুন। পরিবার নিয়ে বা নিজে অকারণে স্থানান্তর হবেন না। শহর থেকে করোনা বয়ে নিয়ে গ্রামে ছড়িয়ে দেয়ার ঝুঁকি নেয়াটা কোনক্রমেই ঠিক নয়। আক্রান্ত কেউ এমনকি যার মধ্যে করোনার কোন লক্ষণও নেই তিনিও হয়তোবা মনের অজান্তে করোনা নিয়ে তার পরিবার-পরিজনের মাঝে ছড়িয়ে দেবেন।
হয়তো ঘরে বৃদ্ধ বাবা-মা দাদা-দাদি তাদের মধ্যেই সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকিটা বেশি থাকবে। পরে পাড়া-প্রতিবেশী এমনকি গ্রামের অন্যদের মাঝেও করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকবে। তাই পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়া আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
আর ঈদ-উল-আজহায় অন্যতম প্রধান কাজ পশু কোরবানি করার ধর্মীয় নিয়ম রয়েছে। সেটি অবশ্যই পালন করতে হবে, কিন্তু কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখা অতি জরুরী। অকারণে অপ্রয়োজনে বিভিন্ন হাটে ঘোরাঘুরি করবেন না। বেশি যাচাই-বাছাই করার সময় এটা নয়। যতটা সম্ভব দ্রুততম সময়ে পশু কেনার কাজ সারুন। সম্ভব হলে অনলাইনে কেনাকাটা করুন। এই সময়ে অনলাইনে পশু কেনাকাটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
দল বেঁধে হাটে যাওয়ার দরকার নেই। বিশেষ করে পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তি, বাচ্চা এবং যারা জটিল রোগে ভুগছেন তাদের হাটে নেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। অপেক্ষাকৃত কম বয়স্ক ও সুস্থ যারা, তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে, মাস্ক পরে হাটে যাবেন। জ্বর বা উপসর্গ আছে, এমন কেউ কিছুতেই হাটে যাবেন না।
পশু কোরবানি ও কাটাকুটির সময়ও যথাসম্ভব ভিড় এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করুন। অনেকেই আজকাল নির্ধারিত স্থান থেকে পশু কাটার কাজ সারেন। তাতে বাড়িতে ভিড় এড়ানো যায়। আর বাড়িতে কোরবানি করা হলে কসাই ও সাহায্যকারীদের মাস্ক পরা, হাত ধোয়া ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পালন নিশ্চিত করুন। প্রতিটি এ্যাপার্টমেন্ট ও বাসার নিচে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা ও সাবান-পানি থাকা উচিত। বাইরের লোক যত কম প্রবেশ করবে, তত ভাল। ঈদের নামাজে যাওয়ার সময় নিজের জায়নামাজ সঙ্গে নিন।
বাসা থেকে অজু করে যাবেন। মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে গেলে দূরত্ব বজায় রাখবেন। কোলাকুলি, কদমবুচি বা হাত মেলানো থেকে বিরত থাকুন। অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে।
মাংস ভাগ-বাটোয়ারার সময়ও সব স্বাস্থ্যবিধি মানুন। বাড়ির গেটে ভিড় জমিয়ে মাংস বিতরণ করবেন না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে সর্বাধিক মনোযোগ দিন। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে মাংস দিতে গেলে যতদূর সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে কাজ সারুন। অকারণে ঘোরাঘুরি এড়িয়ে চলুন। নিজের বাসায় নিজের পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করুন।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক মানুষ চরম দারিদ্র্যের মাঝে দিন কাটাচ্ছে। চাইলে কেউ কোরবানির টাকা দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন বা গ্রামে পাঠিয়ে দিতে পারেন, যারা আপনার হয়ে কোরবানি দেবেন।
কোরবানির ঈদে আরেক উপদ্রব ডেঙ্গু
এবার ঈদে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এ সময়টা আসলে ডেঙ্গুর মৌসুম। মাঝে মাঝে থেমে থেমে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টিপাতের দরুন যেখানে-সেখানে জমা পানিতে ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশাগুলো ডিম পাড়ে এবং এতে মশার বংশবৃদ্ধি ঘটে। এই মশাগুলোই আবার বাইরে থাকে সুন্দর সুন্দর ঘরবাড়িতে ঢুকে এবং সেখানে বাথরুম, ফ্রিজের নিচে, এসির নিচে, ফুলের টবে এবং ছাদে যেখানেই জমা পানি থাকে সেখানেই ডিম পাড়ে।
এই মশা সুন্দর সুন্দর ঘর-বাড়িতে থাকতে পছন্দ করে। এজন্যই এদের বলা হয় গৃহপালিত মশা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য প্রতিবেশী ও পাড়া-মহল্লার সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করুন। কোথাও যেন পাঁচ দিনের বেশি জমা পানি না থাকে। কারণ একজনের বাসার জমা পানিতে মশার বিস্তার হলে পাশের বাসার মানুষটি কিন্তু আক্রান্ত হবেন। তাই একা নয়, সবাইকে সচেতন হতে হবে।
কোরবানির পর অনেকের বাসার আশপাশে পানি, রক্ত ইত্যাদি জমে থাকে। রাস্তার নর্দমাগুলো উপচেপড়ে। তাই কোরবানির পর যত দ্রুত সম্ভব ব্লিচিং পাউডার ও পানি দিয়ে এমনভাবে বাসা ও আশপাশ পরিষ্কার করবেন, যাতে পানিটা জমে না থাকে। বর্জ্য যথাস্থানে ফেলুন বা পলিথিনের প্যাকেটে ভরে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীদের জন্য রেখে দিন।
যেখানে কোরবানির পশু রাখা হয়, দেখভাল করা হয় আর পরবর্তী সময়ে কাটাকুটি করা হয়, দরকার হলে সেসব জায়গায় আগে থেকেই মশার ওষুধ স্প্রে করুন। ছোটদেরসহ সবাইকে মশার কামড় থেকে বাঁচানোর জন্য যা যা করা দরকার তা করতে হবে। নিজের ও পরিবারের সুস্থতা আগে। এই সময় কোভিড ও ডেঙ্গুর কারণে শহরের হাসপাতালগুলোতে আবারও কিছু কিছু রোগী ভর্তি হচ্ছে এবং অনেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। তাই ঈদের সময় ও তারপর নিজের এবং পরিবারের সুস্থতার দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিন।
খাবার-দাবারে সতর্কতা
ঈদে খাবার-দাবারের অসংযমের কারণে ডায়রিয়া, বদহজম যেন না হয়। পরিমিত খান, স্বাস্থ্যকর উপায়ে খান। যাদের গ্যাস্ট্রিকের বা পিত্তথলি ও যকৃতের সমস্যা আছে, কোলেস্টেরল বেশি এবং যারা হৃদরোগী, তারা সাবধান থাকবেন।
আবার অতিরিক্ত পরিশ্রমে অসুস্থ হতে পারেন। কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে প্রচুর পানি খাবেন, সবজি ও সালাদ, ফলমূল খাবেন। ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, কিডনি ও হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা খাওয়ার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলবেন। কারণ রক্তে শর্করা বা রক্তচাপ বেড়ে গেলে আপনার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ও জটিলতার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। কাটাকুটি, রান্নাবান্নার সময় তাড়াহুড়ার কিছু নেই। অসতর্কতায় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
অসুস্থ হলে অবহেলা করবেন না
যদি ঈদের ছুটিতে বা এ সময় কেউ জ্বর, কাশি বা এমন উপসর্গে আক্রান্ত হন, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে দেরি করবেন না। আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে রাখুন। প্রচুর পানি, তরল পান করতে দিন। পুষ্টিকর খাবার দিন। যত দ্রুত সম্ভব জ্বরের রোগীর কোভিড ও ডেঙ্গু টেস্ট করে ফেলুন।
সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালগুলোর জরুরী বিভাগ ঈদসহ যে কোন ছুটিতে খোলা থাকে। তাই শ্বাসকষ্ট হলে বা স্যাচুরেশন কমে গেলে দেরি না করে হাসপাতালে নিন। যারা এখনও টিকা নেননি, তারা দ্রুত টিকা নিন। যারা দুটো টিকা নিয়েছেন চার মাস হয়ে গেলে অবশ্যই বুস্টার ডোজ নেবেন।
উপসংহার
ঈদ উদ্যাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে যত্রতত্র হাট বসানো বন্ধ করতে হবে। ক্রেতা-বিক্রেতা, হাটের ইজারাদার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় সরকারকে যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, প্রয়োজনে মানতে বাধ্য করতে হবে। পশু কোরবানি এবং পশুর মাংস প্রস্তুত করার সময়ে যতটা পারা যায় সীমিতসংখ্যক লোককে কাজে লাগাতে হবে। এই সময়ে কাজে নিয়োজিত থাকা সকলের মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। পশু কোরবানি, মাংস প্রস্তুত করার আগে ও পরে প্রত্যেকের হাত সাবান-পানি দিয়ে ভালভাবে পরিষ্কার করতে হবে। এই সময়ে শিশু, বৃদ্ধ এবং যারা অন্যান্য রোগে ভুগছেন তাদের এই প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা ভাল।
কোরবানির মাংস বিতরণে সতর্ক হতে হবে। তা না হলে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি হুমকির মুখে পড়তে পারে। শহরে বা গ্রামে একত্রে জড়ো না হয়ে পরিচিত মানুষদের বাড়িতেই কোরবানির মাংস পাঠিয়ে দেয়া যেতে পারে। মাংস বিতরণের ক্ষেত্রে চেষ্টা করা উচিত অপেক্ষাকৃত খোলা জায়গায়, দূরত্ব বজায় রেখে মাংস বিতরণ করা। মসজিদ, এতিমখানাসহ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে এসব ক্ষেত্রে ধর্মীয় যেসব বিধি আছে সেগুলো যেমন মানতে হবে, তেমনি স্বাস্থ্য-সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, সচেতন হতে হবে এবং নাগরিক দায়িত্বও পালন করতে হবে। একমাত্র স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং টিকা নেয়ার মাধ্যমে আমরা করোনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারব।
লেখক : প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক, ইমেরিটাস অধ্যাপক