ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

মাথার ওপর এ যেন আকাশ নয়, শিল্পীর আঁকা ছবি

প্রকাশিত: ২৩:১৫, ২ সেপ্টেম্বর ২০২১

মাথার ওপর এ যেন আকাশ নয়, শিল্পীর আঁকা ছবি

মোরসালিন মিজান ॥ কবি মহাদেব সাহার সেই কথাটি আজ আবার মনে পড়ল। কয়েক বছর আগে জীবন বাস্তবতা মেনে বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়েছিল তাকে। অনিচ্ছায় দেশ ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে দুঃখ করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বাংলার আকাশ বুক পকেটে ভাঁজ করে নিয়ে যাচ্ছি।’ এত কিছু থাকতে আকাশ কেন? কী আছে বাংলার আকাশে? কবির কাছে সেদিন আর জানতে চাওয়া হয়নি। তবে এখন এই শরতের আকাশ পানে তাকালে উত্তরটা যে কেউ পেয়ে যাবেন। কী ভীষণ নীল এখন আকাশজুড়ে! নীলের ওপর আছড়ে পড়ছে সাদা মেঘ। মনের আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছে। দুয়ে মিলে আশ্চর্য সুন্দর ছবি। হঠাৎ দেখে মনে হয় বিখ্যাত কোন শিল্পী রং তুলি দিয়ে এঁকেছেন! একেক জায়গা থেকে ছবিটা একেক রকম দেখা যায়। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দেখলে এক রকম সুন্দর। শহরের সুউচ্চ ভবনের ফাঁক দিয়ে আকাশ খুঁজে নেয়ার মাঝেও আনন্দ আছে। প্রকৃতিপ্রেমীরা আনন্দটা নিশ্চিত উপভোগ করছেন। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রতিটি ঋতুই ভিন্ন ভিন্ন রূপ আর বৈচিত্র্য নিয়ে হাজির হয়। শরতও এর ব্যতিক্রম নয়। ভাদ্র আশ্বিন দুই মাস শরতকাল। মাত্র কয়েকদিন আগে ভাদ্র শুরু হলো। সেইসঙ্গে শরত। এরই মাঝে নতুন করে সেজেছে প্রকৃতি। ফুটেছে কাশফুল। শরতের আরেক দান শিউলি। প্রিয় ফুলের ঘ্রাণ নাকে আসতে বিশেষ বাকি নেই। কবিগুরুর ভাষায়, ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা-/নবীন ধানের মঞ্জুরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।’ অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।’ নৌকা করে যেতে যেতে বা তীরে দাঁড়িয়ে সাদার মায়াটুকু অনুভব করা যাচ্ছে এখন। শরতের শিউলি বিশেষ মুগ্ধ করেছিল নজরুলকে। সে কথা জানিয়ে তিনি লিখেছিলেন, এসো শারদপ্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে।/এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে...। শরতের মিষ্টি সকালটির বর্ণনাও পাওয়া যায় তাঁর লেখায়, যেখানে তিনি লিখেছেন, শিউলিতলায় ভোরবেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা।/ শেফালি ফুলকে ঝরে পড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা...। তবে সবার আগে প্রিয় ঋতুর আগমনী ঘোষণা করে বাংলার আকাশ-ই। অল্প কিছুদিন আগেও এ আকাশ ছিল ঘোলা। মুখভার করে থাকতা। কাঁদতো যখন তখন। বর্ষা শেষে সেই রূপ বদলে স্বচ্ছ আর যেন নতুন এক আকাশ। ‘এসো গো শারদল²ী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,/এসো নির্মল নীলপথে।’ নির্মল নীল পথপানে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে বাঙালী। ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলাÑ/নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই- লুকোচুরি খেলা...।’ জমে উঠেছে লুকোচুরি খেলাও। অবশ্য শরতে শুধু প্রকৃতি নয়, মনও কেমন যেন বদলে যায়। পরিবর্তিত হয়। সেই পরিবর্তনের কথা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে।/আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে...। নজরুল শরতে হারানো প্রিয়াকে মিস করেছেন খুব করে। লিখেছেন, শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ/ এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথি কই। একইরকম বিরহ আক্রান্ত হয়ে কবি লিখেছেন, দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে আজ শরতের ভোর হাওয়ায়।/শিশির-ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধে কেন কান্না পায়...। প্রায় অভিন্ন অনুভ‚তির প্রকাশ ঘটিয়ে কবিগুরু লিখেছেন, আজি শরতপানে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়।/ ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কী যে গায় গো...। কবিতার এসব ছন্দ বলে দেয়, দারুণ আবেগের ভালবাসার ঋতুটি শরত। প্রতি বছরই বর্ণাঢ্য আয়োজনে প্রিয় ঋতুকে বরণ করে নেয়া হয়। নাচ গান কবিতায় শরত বন্দনা করে বাঙালী। ঢাকার সংস্কৃতি কর্মীরা বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বর্তমানে করোনা সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসায় প্রস্তুতি নিচ্ছেন শরত উৎসবের আয়োজকরা। রাজধানীতে আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর শরত উৎসবের আয়োজন করা হবে। মূল আয়োজক মানজার চৌধুরী সুইট বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, শিল্পকলা একাডেমির কফিহাউস চত্বরে উৎসব আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। সব ঠিক থাকলে এদিন নাচ গান কবিতার ভাষায় প্রিয় ঋতুর বন্দনা করা হবে। সব মিলিয়ে প্রথম মাস ভাদ্রেই উদ্ভাসিত শরত।
×