
সমুদ্র হক ॥ মৃৎশিল্পের কারিগরদের দুর্দিনে তারা বসে থাকেন। টিকে থাকার লড়াইয়ে উদ্ভাবন করেছেন ঋতুবৈচিত্রের সাধারণের ব্যবহার নানা সামগ্রী। শীতের মৌসুমে বাঙালীর জীবনে পিঠাপুলি থাকতেই হবে। তা না হলে শীতই বেমানান। মৃৎশিল্পীরা বানিয়েছে বাহারি পিঠা বানানোর বাসনকোসন। নক্সি পিঠার জন্য মাটির ছাঁচও বানিয়েছে। মাটির পাত্রে তৈরি পিঠা যে সুস্বাদের হয় বাঙালী ললনারা তা জানে। বিশেষ করে গাঁয়ের বধূ বংশ পরম্পরায় জেনে এসেছে লোহার কড়াইয়ে, এ্যালুমিনিয়ামের পাতিলে, কলিকালের ফ্রাইপ্যানে আর যাই হোক পিঠা ভাল করে বানানো যায় না। বগুড়ার সোনাতলার রানীরপাড়া গ্রামের গৃহবধূ শামীম আরা রুম্পা বললেন, খড়ির চুলায় তাপ নিয়ন্ত্রণে মাটির পাত্রে বানানো পাটিসাপটা পিঠার স্বাদই আলাদা। একেবারে মুখে লেগে থাকে। শিখেছেন তার নানির কাছ থেকে।
বগুড়ার মৃৎশিল্পীরা শীত মৌসুমে গ্রামে পিঠা তৈরির ধুম বিবেচনায় এনে মাটির পাত্রে সহজে পিঠা বানানো যায় এমন পন্থা উদ্ভাবন করেছেন। বগুড়া-ঢাকা মহাসড়কের ধারে শাজাহানপুর উপজেলার আড়িয়াবাজার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার ভেতরে করতোয়া নদীর তীরে ডেমাজানি পালপাড়ায় পৌঁছে দেখা যায়, কুমোরবাড়িতে সারি সারি তৈজসপত্র শুকানো হচ্ছে। একটা সময় করতোয়া দিয়ে বড় নৌকায় মাটির পাত্র ভরে বিভিন্ন স্থানে যেত। এখন করতোয়া নদী শুকিয়ে গেছে। মৃৎশিল্পের কারিগররা কেউ পেশা বদল করেছেন। কেউ টিকে থাকার ভিন্ন উপায় নিয়েছেন। যার একটি পিঠা তৈরির উপকরণ।
ভজন রানী পাল বললেন, বছর পনেরো আগে প্রায় দেড়শ’ ঘর পাল ছিল। বাপ দাদার পেশা টিকিয়ে রাখতে এখন ঠেকেছে ৪০ এ। আক্ষেপে বললেন, ভরবছর শুধু দইয়ের হাড়ি বানিয়ে কি সংসার চলে! বগুড়ার দইয়ের সুনাম থাকায় দই ভরানোর সরা, ডুঙ্গি ভাণ্ড বানিয়ে কোন রকমে টিকে আছেন পালরা। গত ক’বছর ধরে পালরা কার্তিক মাস শুরু হলেই পিঠা তৈরির মাটির হাড়ি তাওয়া, কয়েক ধরনের খোলা (সাত খোলা, পাঁচ খোলা, তিন খোলা ইত্যাদি), ভাপা পিঠা বানানোর হাড়ি বানিয়ে কাছের হাটবাজারে বিক্রি করছেন। বিধান কুমার পাল বললেন, শহরের অনেক নারী নক্সি পিঠা বানানোর খোলা ও ছাঁচ চায়। এ জন্য বিশেষ ধরনের খোলা বানাতে হয়। অঞ্জলী রানী পাল জানালেন, এঁটেল ও পলি এই দুই ধরনের মাটি দরকার হয় পিঠা বানানোর তৈজসপত্রে। নীলমণি মোহন্ত জানালেন, মাটির মিশ্রণ ঠিক থাকতে হয়। এক ট্রলি এঁটেল মাটির দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। পলি মাটির দাম ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। তৈজস বানাতে কয়েকটি পর্যায় থাকে। প্রথমে মাটি প্রস্তুত। এরপর কাঁচা মাটির পাত্র বানিয়ে রোদে শুকানো। তারপর ১৬শ’ থেকে ১৮শ’ পিঠা বানানোর সামগ্রী সাজিয়ে একটা পন তৈরি করতে হয়। এই পন পুড়তে অন্তত এক সপ্তাহ সময় লাগে। খরচ হয় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। এই পরিমাণ হাড়ি পাতিল বিক্রি হয় ২৫ থেকে ২৬ হাজার টাকা। বাঙালীর পিঠা তৈরিতে এভাবে এগিয়ে এসেছে মৃৎশিল্পীরা।
বাঙালীর শিকড়ের সংস্কৃতি পিঠা। ভাপা পিঠা, কুশলি পিঠা, তেল পিঠা, বড়া পিঠা, নকশি পিঠা, গড়গড়ে পিঠা, দমদমাসহ কত নামের যে বাহারি পিঠা তৈরি হয়েছে। পিঠার সঙ্গে সঙ্গী হয়ে এসেছে পুলি। পুলি পিঠা কুশলি পিঠার এক জাত। রসের পিঠা- বিশেষ করে খেজুর রসে চিতই পিঠা ডুবিয়ে রেখে বানানো। হালে নক্সি পিঠা নামের নানা ধরনের পিঠা বের হয়েছে। মূলত এই পিঠা পূর্ববর্তী সকল পিঠার আধুনিক সংস্করণ। যারা পিঠা তৈরি করে তাদের আলাদা কদরই আছে। একটা সময় ভাল পিঠা বানানেওয়ালীদের হায়ার করা হতো। আজও এই চল আছে। গ্রামে কে পিঠা ভাল বানাতে পারে তারও একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই প্রতিযোগিতায় পরোক্ষভাবে সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছেন মৃৎশিল্পীরা। তাদের তৈরি মাটির পাত্র পিঠার স্বাদ অনেক বাড়িয়েছে।