ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৩ মে ২০২৫, ২০ বৈশাখ ১৪৩২

নতুন করে তদন্ত শুরু, পলাতক নেতাদের গ্রেফতারে অভিযান

জামায়াতী এনজিও চাষী কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে জঙ্গী অর্থায়ন

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

জামায়াতী এনজিও চাষী কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে জঙ্গী অর্থায়ন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীর ‘বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতি’ নামের এনজিওটির মাধ্যমে জঙ্গী অর্থায়নের বিষয়ে নতুন করে তদন্ত শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের মানিলন্ডারিং ইউনিট নতুন করে মামলাটির গভীর তদন্ত শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই এনজিওটির সঙ্গে জড়িত গ্রেফতারকৃত আট জামায়াত নেতাসহ ১৬ জনের বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। চাষী কল্যাণ এনজিও মোট চার প্রতিষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে জড়িত পলাতক আরও দশ জামায়াত নেতাকে এ সংক্রান্ত ঘটনায় দায়েরকৃত মানিলন্ডারিং মামলায় গ্রেফতারে নতুন করে তৎপরতা শুরু হয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের মানিলন্ডারিং বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ইতোমধ্যেই এনজিওটির নিবন্ধন বাতিলের জন্য সিআইডির তরফ থেকে বাংলাদেশ এনজিও ব্যুরোকে সুপারিশ করা হয়েছে। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের মানিলন্ডারিং ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে জানান, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় সিআইডির অর্গানাইজড ইউনিট মামলাটির জোরালো তদন্ত শুরু করে। ওই সময় সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম এনজিওটির সঙ্গে জড়িত আট জামায়াত নেতাকে গ্রেফতার করেছিলেন। মামলাটির জোরালো তদন্ত চলছিল। চলতি বছর নতুন করে বাংলাদেশ ব্যাংক ওই মামলাটির আবারও জোরালো তদন্ত করার নির্দেশনা দিয়েছে। সেই নির্দেশনা মোতাবেক মামলাটির গভীর তদন্ত শুরু হয়েছে। এনজিওটির সঙ্গে জড়িত পলাতক থাকা জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারে নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছেন তারা। মামলাটির নথিপত্রের বরাত দিয়ে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের একজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ও ২০১৪ সালে যুদ্ধাপরাধ মামলার বিচার চলাকালে যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি হিসেবে মৃত্যু হওয়া জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতি নামের এনজিওটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৭৭ সালে এনজিওটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। দীর্ঘ ১৫ বছর চেষ্টা করার পরেও এনজিওটি নিবন্ধিত হতে পারেনি। এমনকি সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলেও এনজিওটিকে নিবন্ধন দেয়া হয়নি। সর্বশেষ বিএনপি ক্ষমতা লাভের পর সর্বপ্রথম ১৯৯২ সালে এনজিওটি সমাজসেবা অধিদফতর কর্তৃক নিবন্ধিত হয়। এরপর ২০০৫ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকাকালে এনজিও ব্যুরো এ্যাফেয়ার্স থেকে এনজিও হিসেবে সমিতিটি নিবন্ধিত হয়। গঠনতান্ত্রিকভাবে এটি এনজিও বিষয়ক ব্যুরো থেকে অরাজনৈতিক বেসরকারী উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান (এনজিও) হিসেবে অনুমতি পায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এনজিওটির যাবতীয় কার্যক্রম বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে লিখিতভাবে অবহিত করা হতো। যা বেআইনী। এই এনজিওটি ছাড়াও জামায়াতে ইসলামীর কৃষিবিদরা নব কৃষি প্রাইভেট লিমিটেড ও নবধারা কল্যাণ ফাউন্ডেশন নামের আরও দুইটি সংগঠন গড়ে তুলে। তিনটি সংগঠনের বিরুদ্ধেই মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ প্রচারে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করত জামায়াত। সেই অর্থ নিজেদের রাজনৈতিক দলের সদস্যদের দেয়ার পাশাপাশি আত্মসাত, জঙ্গী ও সন্ত্রাসের কাজে অর্থায়ন করা হতো। হিসেব মোতাবেক ২০০৭-১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতির এ্যাকাউন্টে ৬২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা বিদেশ থেকে অনুদান হিসেবে আসে। ২০১২-১৬ সালে মোস্তাক আহমেদ খাঁ তুরস্কের ধর্মীয় উগ্রগোষ্ঠী থেকে অর্থ এনে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় জঙ্গীবাদ বিস্তার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন করে। পরবর্তীতে মোস্তাক আহমেদ খাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নবধারা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা হাসানুল বান্নাকে গ্রেফতার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। পরবর্তীতে সংগঠনটির মিরপুর ডিওএইচএস এর ১১ নম্বর সড়কের ৭৫ নম্বর বাড়ির অফিস থেকে নব কৃষি প্রাইভেট লিমিটেডের কর্মচারী ইসমাইল হোসেন গ্রেফতার হয়। নবধারা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ মুহাম্মাদ মাসউদ জঙ্গীবাদে অর্থায়ন ও নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গীবাদকে উৎসাহিত করত। মামলা তদন্তের ধারাবাহিকতায় অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের জামায়াতে ইসলামীর সাবেক এমপি হামিদুর রহমান আযাদের নির্দেশে ‘বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতি’র এ্যাকাউন্ট থেকে ৪২ লাখ টাকা ‘নব কৃষি প্রাইভেট লিমিটেডে স্থানান্তর করা হয়। একইভাবে ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতির থেকে নব কৃষি প্রাইভেট লিমিটেডের এ্যাকাউন্টে আরও ১০ লাখ টাকা স্থানান্তর করে। বাংলাদেশ চাষী কল্যাণের নামে তারা অধিকাংশ বিদেশী অনুদান সংগ্রহ করলেও তা চাষীদের কল্যাণে ব্যয় করা হতো না। নিজেরাই ইচ্ছেমতো মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণে কিছু অংশ ব্যয় করত। বাকি টাকা দেশে মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ প্রচারে কাজে ব্যয় করত। এ সংক্রান্ত হবিগঞ্জের বানিয়াচং ও সদর থানায় এবং ঢাকার রমনা মডেল থানায় ও কাফরুল থানায় একটি করে মোট তিনটি মামলা আছে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বিক তত্ত্বাবধায়নে ও নির্দেশনায় মামলাগুলোর তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের মানিলন্ডারিং ইউনিট। তদন্তের এক পর্যায়ে ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের মানিলন্ডারিং টিমের হাতে মামলার আসামি হিসেবে গ্রেফতার হয় জামায়াত নেতা ও এনজিওটির বিভিন্ন পদে থাকা মুহম্মদ ফজলুল হক রিকাবদার। পিতা-মৃত আব্দুল আজিজ রিকাবদার। বাড়ি নরসিংদী জেলার শিবপুর থানাধীন খড়িয়া গ্রামে। ফজলুল হক ঢাকার কলাবাগানের কাঁঠালবাগানের ৭৭ নম্বর বাড়িতে বসবাস করেন। হুমায়ুন কবীর। বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রায়গঞ্জ থানাধীন ডুমুরিয়ার মুন্সীবাড়ি গ্রামে। আশরাফুল হক। পিতার নাম মৃত মুন্সী জাকিরুল হক। মায়ের নাম মৃত মালেকা বেগম। বাড়ি ঝিনাইদহ জেলা সদরের চাকলাপাড়া গ্রামে। তিনি রাজধানীর ভাটারা থানাধীন মসজিদ রোড়ের পূর্ব নূরের চালার ডি ব্লকের ৪ নম্বর লেনের ৪৬ নম্বর বাড়িতে। আসগর হোসাইন। পিতার নাম মোঃ ইয়াকুব আলী সরদার। বাড়ি যশোর জেলার কেশবপুর থানাধীন মঙ্গলকোট গ্রামে। তিনি মগবাজারের পূর্বনয়াটোলার ৩০/১/৩ নম্বর বাড়িতে থাকতেন। শেখ শাহজাহান কবীর। পিতার নাম মৃত শেখ ইসমাইল। মায়ের নাম মৃত মালেকা বেগম। বাড়ি ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানাধীন পশ্চিম খাবাসপুর গ্রামে। তিনি হাতিরঝিল মীরবাগের ১/এইচ/২ কাজী মনজিদে বসবাস করতেন। মোঃ মনিরুল ইসলাম। পিতা-মৃত বেলায়েত হোসেন। মাতা মৃত জোবেদা বেগম। বাড়ি খুলনা জেলার রূপসা থানাধীন তিলক গ্রামে। মোঃ আব্দুর রউফ। পিতার নাম মৃত আব্দুল আজিজ। বাড়ি ফরিদপুর জেলার স্টেশন রোডের আজিজ কুটিরে। অপরজন আল মামুন খন্দকার। পিতার নাম সুলতানুল আলম খন্দকার। মায়ের নাম মোছাঃ মরিয়ম বেগম। বাড়ি পটুয়াখালী জেলার টাউন জৈনকাঠি এলাকায়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৭ নবেম্বর রাজধানীর পল্লবী থানাধীন মিরপুর ডিওএইচএস-এর ৯ নম্বর সড়কের ৬৪৪ নম্বর বাড়ির ৫ম তলায় জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত ‘স্মল কাইন্ডনেস বাংলাদেশ (এসকেবি)’ নামের একটি এনজিও থেকে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ জঙ্গীবাদে অর্থায়নের জন্য সংগ্রহ করা ১৪ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার করে সাফ ওয়ানুর রহমান (৩৪), সুলতান মাহমুদ (২৫), নজরুল ইসলাম (৩৮), আবু তাহের (৩৬), ইলিয়াস মৃধা (৩০), আশরাফুল আলম (২৪), হাসনাইন (৩০) ও কামরুল (২৮) নামের আট জনকে। সিআইডি ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অভিযানে মোট ১৬ জন গ্রেফতার হয়। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীর সংখ্যাই বেশি। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, মানিলন্ডারিং আইনে দায়েরকৃত মামলার আসামি হিসেবে পলাতক থাকা জামায়াত নেতা ও এনজিওটির বিভিন্ন পদে থাকা মুহাম্মদ আব্দুল করিম, গোলাম রাব্বানী, জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আমির প্রয়াত গোলাম আযমের আত্মীয় শেখ মোঃ জিল্লুর রহমান আজমী ও শেখ মুহাম্মদ মাসউদ, ড. মোঃ সানাউল্লাহ, সিরাজুল হক, এসএম জাকির, নুরুল আমিন ফারুক, জামায়াতে ইসলামীর কক্সবাজার-২ আসনের সাবেক জামায়াতের এমপি হামিদুর রহমান আযাদ ও মোস্তাক আহমেদ খাঁকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
×