ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

ভাগ্যের সন্ধানে মালয়েশিয়ায় গিয়ে দুর্বিষহ জীবন

কোন স্বপ্নই এখন ওরা দেখে না... রাতদিন পুলিশের ভয়

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১১ জানুয়ারি ২০১৭

কোন স্বপ্নই এখন ওরা দেখে না... রাতদিন পুলিশের ভয়

ফিরোজ মান্না, কুয়ালালামপুর থেকে ॥ দালাল থেকে ওদের মুক্তি মেলেনি। দেশে দালালের হাত ধরে নৌকায় সাগর পথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিয়েছিল ওরা। ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে ওরা জীবন বাজি রেখেছিল। প্রাণ হাতে নিয়ে ওরা বাজি জিতে অবশেষে মালয়েশিয়া পৌঁছে। যে স্বপ্ন নিয়ে ওরা সাগর পাড়ি দিয়েছিল মালয়েশিয়ার মাটিতে পা দিয়েই সেই স্বপ্ন ভাঙতে শুরু করে। নিজের জীবন বদল করে পরিবারকে সচ্ছলতা দেয়ার কথা ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছে ওরা। এখন ওদের সব আশায় ‘গুড়ে বালি’। কোন স্বপ্নই এখন আর ওরা দেখে না। রাত দিন কেবল পুলিশের ভয় আর লুকিয়ে থাকা। ধরা পড়লে জেলে যেতে হবে। জেল থেকে ছাড়া পেলে দেশে ফিরতে হবে। এটাই এখন ওদের নিয়তি। এমন এক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বাড়িঘর জমি জমা বিক্রির টাকা তোলার জন্য তবুও লড়াই করে যাচ্ছে। ঋণমুক্তির চিন্তা সব সময় মাথায় নিয়ে-লুকিয়ে কাজ করছে ওরা। ঋণের টাকা শোধ করার জন্য তাই বাঙালী দালালরাই ওদের ভরসা। শুধু যে সাগর পথে ওরা এসেছে তাই নয়। অছাত্রকে ছাত্র বানিয়ে আবার কাউকে ‘ট্যুরিস্ট’ ভিসায় এনে এমন বিপদে ঠেলে দিয়েছে দালাল চক্র। এখন দালালরা ওদের পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করার নামে প্রতিমাসে বেতনের অর্ধেক টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই সুযোগ নিয়োগকর্তারাও কাজে লাগাচ্ছে। অবৈধ কর্মীদের অল্প বেতনে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। কুয়ালালামপুরে পথে পথে এমন অনেক কর্মীর সঙ্গে গত কয়েক দিনে আমাদের কথা হয়েছে। তাদেরই একজন নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারের কলাগাছিয়া গ্রামের সামসুল হক। তিনি কুয়ালালামপুরের চেরাস মালুরি এলাকায় থাকেন। সে অবৈধভাবে দেশটিতে ঢুকেছে। দুই বছর আগে বড় ছেলে আল আমিনকেও স্টুডেন্ট ভিসায় নিয়ে আসেন মালয়েশিয়ায়। তাঁকে আনতে তিন লাখ টাকার দালালকে দিতে হয়েছে। কুয়ালালামপুরের কোতারায়া বাংলা মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে দুঃখের কথা জানালেন। তাঁর ভাতিজা ফারুক হোসেন ও প্রতিবেশী নূর হোসেনের ছেলে মোঃ জামানের একই অবস্থা। সেই টাকা পরিশোধ করার জন্য দিনরাত নির্মাণ কর্মী হিসাবে কাজ কওে যাচ্ছে। সামসুল হকের পরামর্শ, দালালদের কথায় আর কারও সন্তান যেন স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় না আসে। অবৈধ পথে আসা কর্মীরা বৈধ হওয়ার সুযোগ পাবেন না। শুধু আল আমিন, আবু তাহেরই নন, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, পেনাং, জহুরবারু অঞ্চলে স্টুডেন্ট ভিসায় এসে অনেকেই এখন মহাবিপদে পড়েছেন। মালয়েশিয়ায় এলেও এখন অবৈধ হয়ে থাকতে হচ্ছে। বিভিন্ন কারখানা, কোম্পানি কিংবা রেস্টুরেন্টও এখন আর আগের মতো অবৈধ শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে চায় না। কারণ কোন প্রতিষ্ঠানে ইমিগ্রেশন পুলিশ অভিযান চালিয়ে অবৈধ কর্মী কিংবা কর্মী পেলে প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষকে জনপ্রতি অবৈধ কর্মীর জন্য ১৫ হাজার রিঙ্গিত জরিমানা গুনতে হয়। আর জরিমানার ভয়ে অনেকেই অবৈধ কর্মী নিতে চায় না। মালয়েশিয়ায় ২০০৮ সালের পর বৈধভাবে কর্মী নিয়োগ বন্ধ হওয়ার পরও হাজার হাজার তরুণ মালয়েশিয়ায় আসে। এদের অনেকেই অনলাইন নিবন্ধন করে বৈধ হওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশ নিলেও অনেকেই ভিসা ফি সাত হাজার রিঙ্গিতের বেশি খরচ পড়ে বলে বৈধ হওয়ার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে না। প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় আসতে পারলে কেউ তিন-চার লাখ টাকা খরচ করে অন্য ভিসায় আসত না।’ বৈধভাবে মালয়েশিয়া আসার প্রক্রিয়া দেরি হওয়ায় অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে জানায়, শুধু স্টুডেন্ট ভিসাই নয়, ডিপি-১০, ট্যুরিস্ট ভিসাসহ বিভিন্ন ভিসার নামে যেসব কর্মী বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া এসেছে তাদের ৯০ শতাংশই অবৈধ হয়ে পড়েছে। এখানে এখন বৈধ কর্মীর চেয়ে অবৈধ কর্মীর সংখ্যা বেশি। ৩ লাখের বেশি অবৈধ কর্মী মালয়েশিয়ায় অবস্থান করলেও তাদের অনেকেই চাকরি পাচ্ছে না কিংবা মোটা অঙ্কের জরিমানার ভয়েও বেশির ভাগ কারখানা বা কোম্পানি এসব অবৈধ কর্মী কাজে নিচ্ছে না। কুয়ালালামপুরের মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ ব্যবসায়ী এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রাশেদ বাদল বলেন, ‘মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরসহ বিভিন্ন রাজ্যে যেখানে যাবেন সেখানেই বাংলাদেশী। কয়েক লাখ কর্মী এখনও অবৈধভাবেই আছে, তাদের অনেকেই এখন চাকরি পাচ্ছে না। তবু মালয়েশিয়ায় কর্মী সংকটে আছে। শুধু কারখানা, প্ল্যান্টেশন ও কৃষিতে লক্ষাধিক কর্মী প্রয়োজন। মালয়েশিয়া বৈধ কর্মী নিতে আগ্রহী। কিন্তু শ্রমবাজারটি খুলবে খুলবে করেও খুলছে না। স্টুডেন্ট ভিসা, ডিপি-১০ ও ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে অনেকেই অবৈধ হয়ে পড়েছে। মানুষ নিরূপায় হয়ে এসব ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়ায় আসছে। কিন্তু বৈধ প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়া আসতে পারলে এসব ভিসায় কর্মী আসত না।
×