ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩১ মে ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বোহেমিয়ার স্ক্যান্ডাল

অনুবাদ : খুররম মমতাজ

প্রকাশিত: ১৮:৩২, ২৯ মে ২০২৫

বোহেমিয়ার স্ক্যান্ডাল

শার্লক হোমস তার নাম দিয়েছিল জাঁহাবাজ মেয়ে। এমন মেয়ে আর হয় না- প্রশংসা করত হোমস। তার মানে এই না- সে ইরিন এডলারের প্রেমে পড়েছে, কিংবা মেয়েটির প্রতি তার দুর্বলতা আছে। প্রেম-ট্রেম হোমসের ধাতে নেই। এসব দুর্বলতা থেকে সে একশ’ হাত দূরে থাকে সবসময়।
প্রেমিক হিসেবে হোমস খুবই বেমানান। প্রেম-ভালোবাসার প্রসঙ্গ উঠলেই সে উল্টোপাল্টা বকতে শুরু করে। তার ধারণা সুন্দরী মেয়েরা পুরুষের কাছে এলেই পুরুষ মানুষের বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পায়- তাই সে মেয়েদের ব্যাপারে আবেগহীন। শুধু ইরিন এডলার ব্যতিক্রম- ইরিনের বেলায় হোমস দারুণ উচ্ছ্বসিত আর প্রশংসামুখর।
ইদানীং হোমসের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ কম হচ্ছে। আমার বিয়েটা তার বড় কারণ। ভিন্ন জীবন দুজনকে দুদিকে নিয়ে গেছে। আমি আছি আমার ঘর-সংসার নিয়ে, আর সে আছে আগের মতোই- অপরাধ, তদন্ত আর নেশার জগতে মগ্ন। পুলিশ যেসব কেসের কূলকিনারা করতে পারে না, হোমস তার তীক্ষè বুদ্ধি আর আশ্চর্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দিয়ে সেইসব কেস সমাধান করে দেয়। পত্রিকার খবর থেকে আমি আমার বন্ধুর সফলতার সংবাদ পাই।
বিয়ের পর আবার ডাক্তারি শুরু করেছি। সেদিন রাতে রোগী দেখে ফিরছিলাম বেকার স্ট্রিট হয়ে। হোমসের কথা মনে পড়লো। কেমন আছে সে, কী করছে এখন- হঠাৎ জানতে ইচ্ছে হলো। তাকিয়ে দেখি ওর ফ্ল্যাটে আলো জ্বলছে। জানালার পর্দায় বন্ধুর পরিচিত ছায়াটাও দেখতে পেলাম। দীর্ঘ ছায়াটা এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে- পায়চারি করছে সে- মুঠো করা হাত দুটো পেছনে, মাথাটা ঝুঁকে আছে বুকের ওপর। এই দৃশ্য আমার খুব পরিচিত- এর মানে নতুন কোনো রহস্য নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন আমার ডিটেকটিভ বন্ধু।
উপরে উঠে বেল বাজালাম। ভেতরে ঢুকে দেখি আমার পুরনো আবাস আগের মতোই আছে। হোমসের মুখ দেখে মনের কথা কখনো বোঝা যায় না, তবু মনে হলো এতদিন পর আমাকে দেখে সে খুশিই হয়েছে। কিছু না বলে কোমল ভঙ্গিতে হাতের ইশারায় চেয়ারটা দেখিয়ে দিল হোমস, সিগার কেসটা এগিয়ে দিলো, কোনার দিকে রাখা পানীয়ের দিকে ইঙ্গিত করলো। তারপর ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ তীক্ষè চোখে আমাকে নিরীক্ষণ করতে লাগলো।
‘বিবাহিত জীবন তোমার বেশ সুখেই কাটছে ওয়াটসন,’ বললো হোমস। ‘সাড়ে সাত পাউন্ড ওজন বেড়েছে।’
‘সাত পাউন্ড।’ আমি বললাম।
‘অবশ্যই অবশ্যই। আরেকটু ভেবেচিন্তে কথা বলতে হচ্ছে তাহলে...দেখতে পাচ্ছি প্র্যাকটিস শুরু করেছো আবার।’
‘কীভাবে জানলে?’
‘আমার দেখা থেকে।’ হোমস বললো। ‘আমি দেখি, দেখাটাকে যুক্তি দিয়ে সাজাই, তারপর সিদ্ধান্তে আসি, ওয়াটসন। সেভাবেই বুঝতে পারছি- ইদানীং প্রচুর হাউস কল পাচ্ছো তুমি, বৃষ্টিতে ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে তোমাকে প্রায়ই, আর তোমার বাড়ির কাজের লোকটা একেবারেই অকম্মা।’
‘হোমস, এটা কিন্তু সত্যিই বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে।’ আমি বললাম। ‘একশ’ বছর আগে জন্মালে তোমাকে ঠিক পুড়িয়ে মারতো ব্ল্যাক-ম্যাজিশিয়ান বলে। গত বৃহস্পতিবার আমাকে গ্রামের দিকে যেতে হয়েছিল ঠিকই, বৃষ্টিতে ভিজে জলে-কাদায় মাখামাখি হয়ে ফিরেছি। তবে সেই পোশাক তো বদলে এসেছি- তুমি কীভাবে টের পেলে বুঝতে পারছি না। আর আমাদের কাজের মেয়ে মেরি সত্যিই অকম্মা- আমার বউ তাকে বিদায় করতে পারলে বাঁচে। কিন্তু অবাক হচ্ছি ভেবে- এতকিছু তুমি জানলে কীভাবে?’
হাসলো হোমস। ‘ভেরি সিম্পল, ওয়াটসন,’ বললো সে। ‘তোমার বুটজুতার গায়ে ঘষাঘষির দাগ দেখতে পাচ্ছি। ধারালো কিছু দিয়ে শুকনো কাদা সরানো হয়েছে। আনাড়ি হাতে সরাতে গিয়ে বুটের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে কেউ। বুটের গায়ে কাদা মানেই খারাপ আবহাওয়ায় বাইরে ঘোরাঘুরি। আর বুটের দফারফা দেখেই ধারণা করা যায়- বাড়িতে আনাড়ি কাজের লোক আছে। প্র্যাকটিসের ব্যাপারটা তো আরও সহজ। তুমি ঘরে ঢুকতেই আয়োডিনের গন্ধ পেয়েছি আর তোমার ডান হাতের তর্জনিতে সিলভার নাইট্রেটের দাগ দেখতে পাচ্ছি। তাছাড়া টুপিটা একপাশে ফুলে আছে। তার মানে স্টেথোটা রেখেছো তোমার টুপির নিচে। এত কিছু দেখেও যদি বুঝতে না পারি। তাহলে তো নিজেকেই আমার অকম্মাার ধাড়ি বলতে হয়।’
এত সহজ করে সবকিছুর ব্যাখ্যা দিল হোমস- না হেসে পারলাম না। বললাম, ‘তোমার যুক্তিগুলো যখন শুনি, মনে হয় এ তো একদমই সহজ কাজ- মনে হয়, আমিও পারবো। কিন্তু ভাবতে নিলেই দেখি- প্রতিটা ধাপে আমাকে থামতে হচ্ছে, জট পাকিয়ে যাচ্ছে- জটগুলো ছোটে শুধু তোমার ব্যাখ্যা শোনার পর। অথচ তোমার মতোই একজোড়া চোখ আমারও আছে।’
‘ঠিক কথা ওয়াটসন।’ পাইপ জ্বালালো হোমস, সোফায় বসে বললো , ‘তোমারও চোখ আছে। তুমি দেখ ঠিকই কিন্তু পর্যবেক্ষণ করো না। এখানেই পার্থক্য। একটা উদাহরণ দিই। তুমি তো সিঁড়িগুলো পার হয়ে এই ঘরে এসেছো বহুবার, তাই না?’
‘হ্যাঁ, তা এসেছি।’      
‘কতবার হবে?’
‘কয়েকশ’ বার তো হবেই।’
‘এখন বলো দেখি সিঁড়ির সংখ্যা কত? ক’টা ধাপ ওখানে?’
‘সিঁড়ির সংখ্যা...তা তো ঠিক জানি না!’
‘তাহলেই দেখো। তুমি পর্যবেক্ষণ করছো না। আমি দেখছি এবং পর্যবেক্ষণ করছি, এখানেই পার্থক্য। মোট ১৭টা সিঁড়ি আছে ওখানে। আচ্ছা যাক, এসবে যখন তোমার এত আগ্রহ, আর আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের দু’একটা গল্প তুমি লিখেও ফেলেছো- তাই ভাবছি এই ঘটনাও হয়তো তোমার কৌতূহল জাগাবে।’ কথাটা বলে টেবিলের উপর থেকে এক তাড়া নোট আমার দিকে এগিয়ে দিল হোমস। ‘এগুলো আজকের পোস্টে এসেছে,’ বললো সে। ‘পড় দেখি জোরে জোরে।’
নোটে কোনো তারিখ দেওয়া নেই, সিগনেচার কিংবা ঠিকানাও নেই। নোটে লেখা-
একজন আসবে আজকে আপনার কাছে, পৌনে আটটার সময়- একজন ভদ্রলোক, যিনি আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে চান খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। সম্প্রতি ইউরোপের একটি রয়্যাল পরিবারকে আপনি যে সার্ভিস দিয়েছেন, তা থেকে আমাদের ধারণা জন্মেছে অতি গোপনীয় এই বিষয়েও আপনার ওপর আস্থা স্থাপন করা যায়। আপনার সুনাম সম্পর্কে আমরা অনেকের কাছ থেকে জানতে পেরেছি। উল্লেখিত সময়ে ঘরে থাকবেন, আপনার ভিজিটর যদি মুখোশ পরে থাকে, অবাক হবেন না।
‘এ তো বিরাট রহস্য!’ আমি মন্তব্য করলাম। ‘এসবের মানে কী?’  (চলবে...)

প্যানেল

×