
মাহিমের পিতা মৌলানা তৈয়ব আলী পার্শ্ববর্তী গ্রামের একটি দাখিল মাদ্রাসায় অনুচ্চ পদে শিক্ষকতা করেন এবং অবসর সময়ে গ্রামের বাজারে নিজস্ব দোকান দেখাশোনা করেন। চেহারায় গাম্ভীর্যের ছাপ, থুতনিতে একমুষ্টি দাড়ি, ফিকে-ফরসা রঙের, বচন রুক্ষ, মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। শিক্ষিত বলেই হোক কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তির দরুনই হোক- সকলেই তাকে অত্যন্ত সমীহ করে চলে। স্ত্রী জাহানারা বেগম সচরাচর স্বামীর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে সাহস করেন না। একমাত্র পুত্র মাহিমের সঙ্গেও তার কালে-ভদ্রে দেখা-সাক্ষাৎ কিংবা বাক্যের আদান-প্রদান হয়ে থাকে। তৈয়ব আলী বাল্যকাল থেকেই সংসারের আর্থিক দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাই অঢেল অর্থ প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা জেঁকে বসেছিল তার মনে। মেহনত জীবনে কম করেননি, প্রচুর সম্পদও সঞ্চয় করেছেন কিন্তু অর্থের প্রতি মোহ অদ্যাবধি ত্যাগ করতে পারেননি। জগতের অন্যসব পিতার মতো তৈয়ব আলীর মনেও কিছু বদ ধারণা পেয়ে বসেছিল। প্রথমত, তিনি মনে করতেন, পুরুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য- অর্থ, গৌরব, ক্ষমতাসমেত একখানা সরকারি চাকরি প্রাপ্তি। সুতরাং সন্তানকে সর্বাপেক্ষা উঁচু শৃঙ্গে ঠেলে তুলতে সদ্যরোপিত চারাগাছে সকাল-সন্ধ্যা পানি ঢালার মতো করে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ সন্তানের পশ্চাতে ফেলতে লাগলেন। কিন্তু লাভের লাভ আদৌ কিছু হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখবার ফুরসতটুকু পেলেন না। দ্বিতীয়ত, পুত্রের সঙ্গে পিতার দহরম-মহরম সম্পর্ক না থাকাই ভালো। কি জানি, কোনো এককালে ভালো ছিল হয়তো! কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে, যেখানে স্বচ্ছন্দে নারী-পুরুষ হয়ে ওঠে, পুরুষ-নারী হয়ে ওঠে, অসৎসংসর্গে নৈতিকতা উৎসন্নে যায়, আবার নির্জনতায় চরিত্র কলুষিত হয়, সেখানে এমন ভালো যে মোটেই ভালো নয়, তা অবশ্যস্বীকার্য। ছেলের আদর্শ যে ক্রমে ক্রমে আধ্যাত্মিকতার চেয়ে আধিভৌতিকতার দিকে এগোচ্ছে, বিলম্বে হলেও তৈয়ব আলী তা উপলব্ধি করলেন। একদিন রাতে খেতে খেতে স্ত্রীর কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে বললেন, ‘শরীরটা আজকাল তেমন ভালো যাচ্ছে না। ছেলেটা যদি বিষয়-আশয়ে একটু নজর দিত!’
জাহানারা শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘সে গুড়ে বালি! সংসারের দিকে মাহিমের একেবারেই মন নেই।’
তৈয়ব আলী গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘কারোই থাকে না। তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে নাকি?’
জাহানারা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘না, তা বলিনি। তুমি কি কিছু করার কথা ভাবছো?’ তৈয়ব আলী বললেন, ‘হু, বিয়ে করিয়ে দিলে কেমন হয়? তবে যদি সংসারে মন আসে!’
জাহানারাও কিছুদিন যাবৎ এ কথা ভাবছিলেন। স্বামীর আগ্রহ দেখে সহসা পুলকিত হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘বেশ তো, কিন্তু আজকালকার ছেলে, যদি এখনই বিয়ে করতে রাজি না হয়?’
তৈয়ব আলী যথাসম্ভব কণ্ঠ উঁচু করে বললেন, ‘রাজি হবে না তো কি দিনদিন অধঃপাতে যাবে!’
পাশের ঘর থেকে মাহিমের কানেও কথাটা গেলো। জাহানারা বেগম আর কোনো উত্তর করলেন না। পরেরদিন ছেলেকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বাবা তোমাকে বিয়ের জন্য গোছগাছ করে নিতে বলেছেন।’
টেবিলে রাখা ফুলদানিটা নাড়তে নাড়তে মাহিম বললো, ‘ওসব বিয়ে-টিয়ে এখন আমার দ্বারা হবে না মা।’ জননী রুষ্ট হয়ে বললেন, ‘আমাকে বলে লাভ নেই বাপু। তোমার বাবাকে বলো গে যাও।’
কেন যে এখন বিয়ে করা সম্ভব নয়, সেই অন্যায় সংস্রবের কথা মায়ের কাছে নিজমুখে ব্যাক্ত করা যেমন লজ্জাকর, তেমনি বাবার কাছে প্রকাশ করাও দুঃসাধ্য। মাহিম ক্রোধ সংবরণ করে দ্রুত পদক্ষেপে সশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পুকুরঘাটে বসে স্বচ্ছ, নির্মল জলের মাঝে জলজন্তুর অবাধ, স্বাধীন বিচরণ দেখতে দেখতে নিজের পরাধীন অদৃষ্টের কথা ভাবতে লাগল। লিজার সঙ্গে সম্পর্ক সাত-আট মাসের। পুরোদস্তুর ক্যারিয়ার সচেতন নারী সে। এই মুহূর্তে কোনোমতেই তাকে বিয়ের জন্য রাজি করানো যাবে না। মায়াকে মনে পড়লো তার। ‘উচ্ছল তারুণ্যের অবিবেচনাবশত একদিন মায়াকে হারাতে হয়েছিল, আর আজ ভাগ্যদোষে লিজাকেও হারাতে বসেছি।’ মনে মনে বিড়বিড় করে বললো মাহিম। ‘হোয়াট ইজ লটেড, ক্যান্ট বি ব্লটেড।’
দুই.
ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে বাবা-মায়ের পছন্দের কন্যার সঙ্গে মাহিমের বিবাহ হয়ে গেল। মাহিম পরিজনের উপর গোঁ ধরে পাত্রী দেখতে গেল না, কন্যার নাম জানলো না, ভালো-মন্দ কিছু শোনার আগ্রহ দেখালো না; তথাপি নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে নির্ঝঞ্ঝাটে এবং নির্বিঘ্নে বিবাহ হয়ে গেল। রাতের আহারের পর থেকেই দোতলার ছাদের ওপর, খোলা আকাশের নিচে মাদুর পেতে শুয়ে আছে মাহিম। রাত তখন প্রায় দুটো বাজে। সদ্যপ্রাপ্ত বিরহদহন বিস্মৃত হয়ে কোনো এক অজ্ঞাত, অপরিচিত তরুণী নববধূর মুখোমুখি হতে কিছুতেই মন টানছিল না তার। তাই এমন নির্জন-অবস্থান। তবু মধ্যরজনির শুক্ল নৈঃশব্দ্য, দক্ষিণ আকাশের পূর্ণবিকশিত চন্দ্রকর এবং আগতপ্রায় পৌষের মৃদুমন্দ শীতল হাওয়া মাহিমকে বিবাহোত্তর রহস্যালাপের প্রতি আধো-আধো টানে আকর্ষণ করতে লাগলো। প্রস্থানের উদ্দেশ্যে গমনোদ্যত হতেই সহসা মেয়েলি পদশব্দ ও নূপুরের নিক্বন কানে এলো তার। আড়চোখে পেছনে তাকিয়ে দেখলো নববধূ স্বয়ং গুটিগুটি পায়ে এদিকেই আসছেন। বিস্ময়ের সঙ্গে মুহূর্তের জন্য রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো মাহিমের মন। নিকটে এসে পদশব্দ থেমে গেলে মাহিম যতটা সম্ভব কোমল কণ্ঠে বলল, ‘বসো।’
মেয়েটি ইতস্তত না করে পাশে বসে পড়লো। মাহিম বলল, ‘এখনো ঘুমোওনি যে?’
বধূ উত্তর দিল না। পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম কী?’
মেয়েটি মুখ নিচু করে বলল, ‘যদি এতদিনে না জেনে থাকেন, তবে গোপনই থাকুক।’
মাহিম মনে মনে বলল, ‘মন্দ নয়।’
মুখে কিছু বলল না। কিন্তু কণ্ঠস্বরটি অদ্ভুতভাবে পরিচিত মনে হলো তার কাছে। বাম দিকে ফিরে বধূর মুখের ওপর থেকে ঘোমটাটা একটুখানি সরিয়ে দিয়ে বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলো সে, ‘মায়া?!’
মায়া একলহমায় হাসির ঝলকে বিস্ময়াভিভূত যুবকের চঞ্চল হৃদয়কে আশ্বস্ত করে দিয়ে বলল, ‘এত রাতে এভাবে চেঁচামেচি করলে লোকে কী ভাববে?’ বিস্ময়ের ভাব কিছুটা কেটে গেলে মাহিম জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি?’
মায়া হেসে বলল, ‘হুম, পছন্দ হয়নি বুঝি?’
মাহিম তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। কেবল উৎসুক দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু...?’
মায়া মাহিমের বাম হাতটা কোলে টেনে নিয়ে বলল, ‘তবে শুনো, যেদিন তোমার সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ হয়, তার পর থেকে আমার শরীর দিন দিন খারাপ হতে থাকে। কারণ খুঁজতে গিয়ে বাবা আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারেন। পরে যখন তোমার জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছিল, তখন আমার বাবা প্রস্তাব নিয়ে তোমাদের কাছে আসেন। এরপরে যা হওয়ার তা-ই।’
মাহিম কিছুটা মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘কিন্তু আমি যে তোমার থেকে লিজাকে বেশি প্রায়োরিটি দিয়েছিলাম!’
মায়া মুচকি হেসে বলল, ‘সেটা তোমার জীবনের মস্ত বড় ভুল ছিল। আমি জানি, তুমি ওকে পেয়ে যতটা তুষ্ট হয়েছিলে, আমাকে হারিয়ে ততোটাই অনুতপ্ত ছিলে। মানুষ ভালোবাসার কাছে ফেরে না, ফেরে সত্যের কাছে। আমার বিশ্বাস ছিল, একদিন না একদিন ঠিকই তোমাকে আমার করে পাব।’
বলতে বলতে কয়েকফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল মাহিমের হাতের ওপর। মাহিম হাত দিয়ে মায়ার কপোলের অশ্রু মুছে দিয়ে তার চাঁদপনা মুখখানা নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। নভোমণ্ডলের অসংখ্য তারকারাজি ভূমণ্ডলের সদ্যবিবাহিত এই দুই যুবক-যুবতীর গাঢ় পবিত্র আলিঙ্গন দেখতে দেখতে পৃথিবীময় সুধা বর্ষণ করতে লাগল।
রাতে মাহিমের নম্বরে পরিচিত একটা নম্বর থেকে টেক্সট আসল- ‘অভিনন্দন। নতুন জীবনে সুখী হও। ইতি লিজা।’
প্যানেল