ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩১ মে ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কাজী আবদুল ওদুদ

মানবতাবাদী ভাবুক ও সাহিত্যিক

এস ডি সুব্রত

প্রকাশিত: ১৮:০৬, ২৯ মে ২০২৫

মানবতাবাদী ভাবুক ও সাহিত্যিক

মানবতাবাদী বাঙালি ভাবুক, সাহিত্যিক ও সমালোচক কাজী আব্দুল ওদুদ যিনি সর্বদা যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হন। ছাত্রজীবনেই ভারতবর্ষ পত্রিকার চৈত্র ১৩২৩ সংখ্যায় শরৎচন্দ্রের বিরাজ বৌ উপন্যাসের সমালোচনামূলক প্রবন্ধ ‘বিরাজ বৌ’ (চরিত্রবিবৃতি) প্রকাশিত হয়েছিল। এটিই তাঁর প্রথম মুদ্রিত সাহিত্যপ্রয়াস। ১৯১৮ সালে বেরিয়েছে গল্পগ্রন্থ ‘মীর পরিবার’, পরের বছর উপন্যাস ‘নদীবক্ষ’। মীর পরিবার পড়ে শরৎচন্দ্র ও শশাঙ্কমোহন সেন লেখককে উৎসাহ দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। আর নদীবক্ষে পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা। ত্রিশ বছর বয়সে লেখা কাজী আব্দুল ওদুদের রবীন্দ্রনাথকাব্য পাঠ পুস্তিকা পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে লিখেছিলেন ‘আমার রচনায় এমন সরস বিচারপূর্ণ সমাদর আর কারো হাতে লাভ করেছে বলে আমার মনে পড়ে না। এর মধ্যে যে সূক্ষ্ম অনুভূতি ও ভাষানৈপুণ্য প্রকাশ পেয়েছে তা বিস্ময়কর। তোমার মতো পাঠক পাওয়া কবির পক্ষে সৌভাগ্যের বিষয়।’ গতানুগতিক চিন্তাধারার অনুসরণ তিনি করেননি। তাঁর রচনা অন্যের চিন্তাকে নাড়া দেয়, ভেঙে দেয় অনেক পূর্বধারণা, পাঠকের মনে জাগিয়ে তোলে নুতন জিজ্ঞাসা। 
কাজী আবদুল ওদুদ গতানুগতিক ভাবনার বাইরে সমাজ ও সম্প্রদায়ের নানা সমস্যার সমাধান খুঁজেছেন। মিলনের মনোভাব গড়ে তুলতে মননশীল সাহিত্যচর্চাকেই জরুরি মনে করেছিলেন তিনি। ফলে প্রগতিশীল যুক্তিবাদী আবদুল ওদুদের সারথি হয়েছিলেন অনেকে। যেমন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, মোহিতলাল মজুমদার, মোতাহার হোসেন চৌধুরী, আবুল ফজল, আবুল হুসেন, কাজী আনোয়ারুল করিম, আবদুল কাদির প্রমুখ। প্রসিদ্ধ এ কৃতী ব্যক্তির পরিচয় দিতে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছিলেন, ‘কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন জাতিতে ভারতীয়, ভাষায় বাঙালি, ধর্মে মুসলমান, জীবনদর্শনে মানবিক, মতবাদে রামমোহনপন্থি, সাহিত্যে গ্যেটে ও রবীন্দ্রপন্থি, রাজনীতিতে গান্ধী ও নেহরুপন্থি, অর্থনৈতিক শ্রেণিবিচারে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক, সামাজিক ধ্যানধারণায় ভিক্টোরিয়ান লিবারেল। কোনরূপ চরমপন্থায় তার বিশ্বাস ছিল না।’ বুদ্ধি-বিচারকে বিসর্জন দিলে মানুষের অনেক আচরণই পশুর আচরণে গিয়ে ঠেকে। কাজী আব্দুল ওদুদের এই ভাবনা-চিন্তা বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক। কাজী আবদুর ওদুদের জন্ম ১৮৯৪ সালের ২৬ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার (বর্তমানে রাজবাড়ী জেলার অন্তর্গত) বাগমারা গ্রামে। মৃত্যুবরণ করেন ১৯ মে ১৯৭০ সালে।
তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯২০ সালে ঢাকা কলেজে বাংলা বিষয়ে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। কাজী আবদুল ওদুদ কয়েকজন ছাত্রের মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি মুসলিম হলের ইউনিয়ন কক্ষে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বের প্রতিষ্ঠা ঘটে ‘মুসিলম সাহিত্য সমাজ’ নামের সংগঠনের। 
এর প্রাণপুরুষ ছিলেন  ভাবুক কাজী আবদুল ওদুদ ও কর্মী আবুল হুসেন। মুক্তবুদ্ধিতে চিন্তাচর্চা করতে গিয়ে সাহিত্য-সমাজের ওপর ঝড়-ঝাপটা যা এসেছিল তা এই দুজনকে কেন্দ্র করেই। ঢাকা অবস্থানকালে গল্প-উপন্যাস নাটিকা-প্রবন্ধ ও সাহিত্য সমালোচনা মিলিয়ে কাজী আবদুল ওদুদের সাতটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। কাজী আবদুল ওদুদ যতখানি লেখেন তাঁর অনেক বেশি ভাবেন এবং লিখতে বসার আগেই তিনি সেই ভাবনা সেরে ফেলেন। এভাবে ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ভাষাও গড়ে ওঠে, মনে মনেই চলতে থাকে তার মাজাঘষা। 
যে-দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্থান সৃষ্টি হয়েছিল তা ছিল কাজী আবদুল ওদুদের জীবনদর্শনের বিরোধী। সে কারণে এবং নিজের চিন্তা চর্চার সুবিধার কথা ভেবে নিজের জন্মভূমি পূর্ব বাংলায় তিনি গেলেন না। অথচ এই অঞ্চলের যাদের জন্ম, দুই-একজন বাদে সবাই এবং পশ্চিমবঙ্গের অনেক পেশাজীবী-লেখক-সাংবাদিক অপশন দিয়ে পূর্ব বাংলায় চলে যান। একমাত্র কন্যা ও দুই পুত্রের একজন তখন ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। কাজী ওদুদ কলকাতা না ছেড়ে আমৃত্যু এখানেই রয়ে গেলেন। শোনা যায় পাকিস্তানের একজন মন্ত্রী তাকে প্রস্তাব পাঠিয়ে ছিলেন তিনি পূর্ব বাংলায় ফিরে গেলে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত করা হবে। এই লোভনীয় প্রস্তাবও তাঁকে মোহগ্রস্ত করতে পারেনি। তাঁর প্রজ্ঞা তাঁকে এই উপলব্ধিতে পৌঁছে দিয়েছিল যে পাকিস্তানে তিনি টিকতে পারবেন না। পাকিস্তানে গেলে কবিগুরু গ্যেটে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, বাংলার জাগরণ, ইত্যাদি অসামান্য বই লেখা সম্ভব হতো না। এত গল্প, উপন্যাস, কাব্য, সংগীত, নাটক লিখেও যেন রবীন্দ্রনাথ মনের কথা মন খুলে বলতে পারেননি। প্রবন্ধের আশ্রয় নিতে হয়েছে। যুক্তি-তর্কই প্রবন্ধের প্রাণ, তার জন্য বিচারবুদ্ধি ও মননশীলতা অপরিহার্য। 
ইউরোপীয় সাহিত্যেও এমন কোন মহৎ ভাবুক নেই, যিনি প্রবন্ধে নিজের মনের ভার লাঘব করতে চাননি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের দেশে বাঙালি সমাজেও রেনেসাঁস তথা নবজন্মের কিছুটা আভাস দেখা দিয়েছিল। ফলে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙ্গালী প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল ধর্মান্দোলন তথা শাস্ত্রের নবতর ব্যাখ্যায় রামমোহন, বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ, সাহিত্যে মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, চিত্রকলায় রবি বর্মা থেকে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিজ্ঞানে জগদীশচন্দ্র, মেঘনাদ সাহা, ইতিহাসে রমেশ দত্ত, যদুনাথ সরকার, রমেশ মজুমদার, রাজনীতিতে ও দর্শনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন শীল, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায়- এমনি আরো বহুদিকে।
কাজী আব্দুল ওদুদ বিশ্বাস করতেন- বুদ্ধির তথা মনের মুক্তি না ঘটলে অর্থাৎ অন্তরে যদি মানুষ মুক্ত-বুদ্ধি না হয় তাতে যে কোনো রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবন বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা জীবনের সর্বাঙ্গীন বিকাশের সহায়ক না হয়ে, হয়ে পড়ে প্রবল বাধা। আলোচনার মাধ্যমে কাজী আবদুল ওদুদ বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি স্বচ্ছ চিত্র তুলে ধরেছিলেন পাঠক সমীপে, এখানেই তাঁর কৃতিত্ব সর্বাধিক। এই কৃতিত্বের একটা বড় অংশের দাবিদার তার ‘শ্বশতবঙ্গ’ গ্রন্থখানি। ‘নদীবক্ষে’ কাজী আবদুল ওদুদের বিখ্যাত উপন্যাস ও ছোটগল্পগ্রন্থ ‘মীর পরিবার’। রবীন্দ্রকাব্য পাঠ, নবপর্যায়ে দ্বিতীয় খণ্ড, সমাজ ও সাহিত্য, হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ, আজকার কথা, কবিগুরু গ্যেটে, শ্বশতবঙ্গ, স্বাধীনতা দানের উপহার, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ-প্রথম খণ্ড, বাংলার জাগরণ, হজরত মোহাম্মদ ও ইসলাম, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ-দ্বিতীয় খণ্ড প্রভৃতি তার প্রকাশিত গ্রন্থ। তাঁর সম্পাদিত ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ’ একখানি জনপ্রিয় বাংলা অভিধান। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ওদুদের উপন্যাসের বিষয়বস্তুর নতুনত্ব, মাধুর্য ও সহজিয়া সুর পাঠককে মুগ্ধ করে। এইভাবে আলোড়ন তুলে।’ আত্মমর্যাদার পরিবারে নানা গল্পে একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করেন ওদুদ। তারপর কিছুদিন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির আবাসিক ভবনে (কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে) বসবাস করেন। সেখানে কবি-সাহিত্যিকদের আনাগোনা- আড্ডা হতো। আড্ডায় অংশ নিতেন যুদ্ধ-ফেরত কাজী নজরুল ইসলামও। আড্ডা-সূত্রে নজরুলের সঙ্গে পরিচিত হন কাজী আবদুল ওদুদ। 
কিশোর বয়সে লেখালেখি শুরু করা ওদুদ কবি-সাহিত্যিকদের সাহচর্যে আরও অনুপ্রেরণা পান। মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামটি রাখার দুটো কারণের কথা উল্লেখ করা রয়েছে। প্রথমত, বাঙালি মুসলিম সমাজের কাছে রেনেসাঁর বাণী তথা মানুষ-কেন্দ্রিক ইহ-জাগতিক বাস্তবতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার কথা তুলে ধরা; দ্বিতীয়ত, সাহিত্যের মাধ্যমে অবহেলিত মুসলমান সমাজের জীবন-ভাবনা সঠিকভাবে চিত্রিত করা যা ওদুদের মতে মেধাবী হিন্দু সাহিত্যিকরা করতে পারেননি। সেসময়ে পারস্যের কবি শেখ সাদি, ওমর খৈয়াম, ফেরদৌসি, হাফিজ ও জালাল উদ্দীন রুমি প্রমুখের উদার মানবতাবাদী ও লৌকিক ভাবনা-সমৃদ্ধ কাব্য সম্ভার তার দৃষ্টিকে প্রসারিত করে।পশ্চাদপদ বিশ্বাস ও সংস্কারের নিকষ কালো অন্ধকারে, বিভ্রান্তির কুহেলিকায় মানুষ যখন যুক্তি ও বুদ্ধির কথা ভুলে সর্বনাশা সংকীর্ণতার চোরাবালিতে ডুবে যায়, সংখ্যাধিক্যের জোরে নিজের মত ও বিশ্বাসের কল্পিত শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নিয়ে অন্যের মত ও বিশ্বাসকে তুচ্ছ ও ক্ষতিকর মনে করে সমাজে হিংসা, বিভেদ ও ভীতির আবহ তৈরি করে, তখনি প্রাকৃতিক নিয়মেই এই অপশক্তি ও আপদের অচলায়তনের মধ্যে সব সময় বিপরীতমুখী কিন্তু সুস্থ ও কল্যাণকামী চিন্তাভাবনা ও দ্রোহী কিছু নির্ভীক, মুক্ত-হৃদয় ও মনের মানুষ উঠে আসেন যাঁরা যুক্তি ও বুদ্ধির নিরিখে জীবন ও জগতে সতত ঘটে চলা পরিবর্তনকে চরম বৈরী পরিবেশেও সত্য বলে প্রচার করেন, ধর্ম, অতীত ঐতিহ্য ও গৌরবকে বস্তুনিষ্ঠভাবে ব্যাখ্যা করে প্রচলিত অন্ধ সংস্কার ও জীবনাচারের অসারতাকে অর্থহীন প্রতিপন্ন করে পুরো সমাজকে জাগিয়ে তোলার সংকল্পে জীবনোৎসর্গ করেন। 
এদের মধ্যে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের মুসলিম পুনর্জাগরনের অন্যতম অগ্রপথিক বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষক ও “বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের” সংগঠক কাজী আবদুল ওদুদ সর্বাগ্র্যগণ্য ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তি। 

প্যানেল

×