ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০২ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

দুর্গম এলাকায় কৃষি বিপ্লব: শিক্ষিত দুই তরুণ উদ্যোক্তার ‘রুপাই ভ্যালি’

ওবাইদুল আকবর রুবেল, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ১৫:২৮, ৩১ মে ২০২৫; আপডেট: ১৫:২৯, ৩১ মে ২০২৫

দুর্গম এলাকায় কৃষি বিপ্লব: শিক্ষিত দুই তরুণ উদ্যোক্তার ‘রুপাই ভ্যালি’

ছবি : জনকণ্ঠ

আব্দুল হালিম ও ওসমান গণি—তারা দুইজন ভালো বন্ধু। দুইজনই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফেনী সরকারি কলেজ থেকে একজন অর্থনীতি ও অন্যজন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত। তারা চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার দুর্গম সীমান্তবর্তী ১ নম্বর বাগানবাজার ইউনিয়নের প্রান্তিক গ্রাম চিকনছড়ার বাসিন্দা। তবে তাদের গল্পটা সমাজের অন্য সাধারণ যুবকদের মতো নয়।

২০২০ সালে করোনার ছোবলে যখন সব কিছু অচল হয়ে পড়ে, তখন কলেজ ছেড়ে নিজ গ্রামে ফেরেন তারা। অলস অবসরের সময় কাটানোর চিন্তা থেকে মাথায় আসে চাষাবাদের ভাবনা। দুই বন্ধু মিলে গ্রামের কিছু একফসলি ধানিজমি লিজ নিয়ে শুরু করেন সবজি চাষ। সফলতার মুখ দেখে ধীরে ধীরে তারা গড়ে তোলেন ৫ একর জমিতে ‘রুপাই ভ্যালি এগ্রো ফার্ম’ নামে দিগন্তজোড়া সবুজ সবজির খেত। লাউ, চিচিঙ্গা, ঢেঁড়স, তিতকরলা, কাঁকরোল, টমেটো, বেগুন ইত্যাদি সবজির পাশাপাশি আছে পেঁপে বাগান। তিন বিঘা লাউ খেতের মাচায় দুলছে লাউ। নাইচ গ্রীন জাতের বারোমাসি লাউয়ের ডগায় ডগায় ফুল আর ফল।

একরের পর একর জমিতে সারা বছর উৎপাদন করছেন নানা স্বাদের ফলমূল ও শাকসবজি। বছর শেষে লাখ টাকা আয় করে প্রমাণ করে দিচ্ছেন—কৃষিও সম্ভাবনাময় শিল্প। জ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এ দুই বন্ধু কৃষিকে নিয়ে যাচ্ছেন অনন্য উচ্চতায়। অল্প সময়েই তাদের সফলতার গল্প ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। যৌথ প্রচেষ্টায় চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির প্রান্তিক পাহাড়াঞ্চলের শিক্ষিত দুই তরুণ উদ্যোক্তার ‘রুপাই ভ্যালি এগ্রো ফার্ম’ এখন সারা দেশের কৃষি উদ্যোক্তাদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে স্থানীয় আরও অনেক মানুষের।

কৃষি সংশ্লিষ্ট দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তারা তাদের স্বপ্নের প্রকল্পটি দেখে যাচ্ছেন এবং এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজেরাও সফল হওয়ার চেষ্টা করছেন। কৃষি বিভাগের মাধ্যমে তাদের মডেল ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে।

সম্প্রতি নিরাপদ সবজি উৎপাদনকারী সফল কৃষক হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ কৃষকের সম্মান-স্বীকৃতিও লাভ করেছেন তারা। চট্টগ্রাম জেলা পর্যায়েও তারা সম্মাননা পেয়েছেন। লেখাপড়া শেষ করে সরকারি চাকরি বা প্রবাসের স্বপ্ন ছুঁড়ে ফেলে এখন তাদের চোখে শুধু মাঠভরা সবুজ সবজি খেত তৈরির লক্ষ্য, বাজারজাতকরণ এবং মানুষকে নির্বিষ নিরাপদ শাকসবজি খাওয়ানোর দৃঢ় সংকল্প। নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি অন্যদেরও চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে তাদের প্রজেক্টে। প্রতিদিন কাঁকরোল ছেঁড়া, কিটনাশক দেওয়া সহ বিভিন্ন কাজে ২০-২২ জন শ্রমিক তাদের প্রজেক্টে নিয়োজিত রয়েছেন।  

রুপাই ভ্যালিতে কাজ করা শ্রমিক মোঃ নুর নবী ও নূর উদ্দিন জানান, গত ৫ বছর ধরে এখানে কাজ করছি। প্রতিদিন আমরা ৫-৬ জনে কাজ করি, তবে যেদিন ফসল তোলা হয় সেদিন শ্রমিক বেশি লাগে। এখানে কাজ করে আনন্দবোধ করেন বলেও জানান তারা।

তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা আব্দুল হালিম জানান, শুরুতে জমিতে লাউ, চিচিঙ্গা, পেঁপে চাষ করলেও বর্তমানে শুধু কাঁকরোল চাষ করছি। পাশাপাশি অন্যান্য বছরের মতো পারিবারিক চাহিদা মেটাতে চিনিগুঁড়া সহ কয়েকটি দেশি জাতের ধান চাষ করবো। চলতি মৌসুমে এ পর্যন্ত প্রায় ২০ লক্ষ টাকার কাঁকরোল বিক্রি হয়েছে। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে আরও ১৫-২০ লক্ষ টাকার মতো বিক্রি করা যাবে।

হালিম আরও জানান, তার প্রজেক্টে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় কাঁকরোল। বছরে ১২ বিঘা জমিতে ৮০ হাজার কেজি কাঁকরোল উৎপাদনের আশা করছেন। তবে গত বছর আগাম অতিবৃষ্টি ও পরবর্তীতে বন্যার কারণে তারা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ফেনী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে খেত থেকে সবজি কিনে নিয়ে যান। ফলে হাট-বাজারে গিয়ে বেচাকেনা করতে হয় না তাদের।

জানা গেছে, রুপাই ভ্যালি এগ্রো ফার্মে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য হলুদ পাতা ও ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার করা হয় এবং জৈব সার প্রয়োগ করা হয়। এই দুটি বালাই দমন পদ্ধতির কারণে কীটনাশক ছাড়াই পোকামাকড় দমন করা সম্ভব হচ্ছে। জৈব পদ্ধতিতে খরচও কম। কৃষি বিভাগ থেকেই নিরাপদ সবজি উৎপাদনের কৌশল শেখানোসহ সব ধরনের পরামর্শ-সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

অপর উদ্যোক্তা মোঃ ওসমান গণি বলেন, এখন দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিনই উৎসুক লোকজন তাদের ফার্ম দেখতে আসেন। ‘জাতীয় সবজি মেলা ২০২২’ উপলক্ষে গত ২ মার্চ সেরা নিরাপদ সবজি উৎপাদনকারী কৃষক হিসেবে তারা জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর উৎসাহী লোকজন এবং সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও তাদের ফার্ম পরিদর্শনে আসছেন। অনেকে তাদের অনুপ্রেরণায় পরিকল্পিত সবজি উৎপাদন শুরু করেছেন।

এদিকে কৃষি বিভাগের উদ্যোগে স্মল হোল্ডার এগ্রিকালচারাল কম্পিটিটিভনেস প্রজেক্টের (এসএসিএপ) আওতায় বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৫০ জন কৃষক সম্প্রতি রুপাই ভ্যালি এগ্রো ফার্ম পরিদর্শনে আসেন। বিষ বা কীটনাশক প্রয়োগ না করে জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে নিরাপদ সবজি চাষের কৌশল দেখে তারা বেশ উৎসাহী হন। পরিদর্শনে আসা দাঁতমারার কৃষক মোঃ রোকন উদ্দিন বলেন, জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদে সহজেই যে পোকামাকড় দমন করা যায়, এখানে না এলে বিশ্বাস করতাম না। পাইন্দং ইউনিয়নের কৃষক মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, এখানকার লাউ চাষের পদ্ধতিটি আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে।

উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হারুন উর রশিদ বলেন, “সরকার নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জোর দিচ্ছে। এ অবস্থায় রুপাই ভ্যালি এগ্রো ফার্মের বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি উৎপাদনের সফলতা সারা দেশের জন্য একটি সুসংবাদ। চাকরির পেছনে না দৌড়ে শিক্ষিত এ দুই তরুণ কৃষি ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী সফলতা অর্জন করেছেন তা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। আমরা উপজেলার অন্যান্য কৃষক সমিতির নেতৃবৃন্দকে রুপাই ভ্যালি পরিদর্শন করে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য উৎসাহিত করছি।”

চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মোঃ নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তাদের রুপাই ভ্যালি এগ্রো ফার্ম এখন হাতে-কলমের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কীটনাশক ছাড়াও যে জৈব পদ্ধতিতে বালাই দমন করে নিরাপদ ফসল উৎপাদন করা যায়—কৃষকরা এখানে এসে তা শিখছেন।”

সানজানা

×