ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২

কবিগুরুর হেমন্ত বন্দনা

অলোক আচার্য

প্রকাশিত: ২১:৩৯, ৯ নভেম্বর ২০২৩

কবিগুরুর হেমন্ত বন্দনা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ষড়ঋতুর যে দুই ঋতু এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে তার একটি হলো হেমন্ত। বাংলার প্রতিটি ঋতুর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। ভিন্ন ভিন্ন রূপ। সব মিলিয়েই এই বাংলা। বাংলার গান, কবিতা, ছড়া, গল্প বা উপন্যাস সব শাখাতেই ঘুরে ফিরে কম-বেশি সব ঋতু এসেছে। ঋতু বন্দনা হয়েছে

বাংলাদেশে প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন রূপ এবং বৈচিত্র্য বহু বছর ধরে কবি, সাহিত্যিক, গায়কের সৃষ্টির উপাদান। ঋতুর পালাবদলের হাত ধরে প্রকৃতিতে এখন হেমন্ত। শরতের শুভ্রতা মিশেছে হেমন্তের ফসলের ঢেউয়ে। শারদ প্রাতে যখন কুয়াশা ভেজার অপেক্ষা থাকে প্রকৃতিতে তখনই আসে হেমন্ত। ধানের ডগায় জমা শিশির, তারপর সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিকের মতো ভ্যানিশ হওয়া হেমন্তের চিরকালীন বৈশিষ্ট্য। ভোরের হিম হিম ঠান্ডায় গায়ে উঠছে ভারি কাপড়। হিম করা এই প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ কবিগুরু। তিনি লিখেছেন গান, কবিতা। মুগ্ধ ছিলেন অন্য কবিরাও।

মুগ্ধ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলোরে/হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে/ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো ‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো/ জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে/শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,/কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে।’ এই যে হেমন্ত ও হেমন্তিকা শব্দদ্বয়ের ব্যবহার তা একই নামের ভিন্ন রূপ। এই লাইন ক’টিতেই হেমন্তের রূপের পরিচয় মেলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেমন্ত নিয়ে বেশকিছু কবিতা ও গান লিখেছেন। বারবার হেমন্ত উঠে এসেছে তার কবিতায় গানে। হেমন্তের মায়ায় কবি প্রতিবার ফিরেছেন হেমন্তের সকাল-ধান পোড়ানো সন্ধ্যায়। হেমন্তের স্তব্ধতা-উদারতা কবিকে মুগ্ধ করেছে।

প্রকৃতি নিয়েই কবিগুরুর সৃষ্টির আশ্চর্য খেলা। আশ্চর্য মায়াজাল রচনা করেছেন। কবির দর্শনে, সৃষ্টিতত্ত্বে প্রকৃতির ঋতুর খুঁটিনাটি উপস্থাপনা করেছেন। আমরা যেভাবে দেখি তিনি সেভাবেই দেখেছেন তবে বৈচিত্র্য এনেছেন বর্ণনায়। কখনো কবিতার শব্দে আবার কখনো সুরে অর্থাৎ গানে-জাগরণে। তিনি ছিলেন নির্ভেজাল প্রকৃতিপ্রেমী। তার কবিতার পরতে পরতে প্রকৃতি। তিনি ছয় ঋতুর অপার সৌন্দর্য গভীরভাবে অনুভব করেছেন। এসবের মাঝেও মিলেছে প্রেম-প্রণয়। তাঁর বিভিন্ন কবিতায়, গানে অন্যান্য ঋতুর মতোই এসেছে হেমন্তের উপস্থাপনা। হেমন্ত ঋতুকে তিনি দেখেছেন নানাভাবে। যদিও বর্ষা বা বসন্তের তুলনায় হেমন্ত নিয়ে একটু কমই রচনা করেছেন তার সৃষ্টিতত্ত্বে। তবুও এসেছে এবং শক্তভাবেই এসেছে।

‘শিশু ভোলানাথ’ কাব্যগ্রন্থের ‘বৃষ্টি রৌদ্র’ কবিতায় তিনি লেখেন : ‘কার্তিকের এই ধানের খেতে/ভিজে হাওয়া উঠল মেতে/সবুজ ঢেউয়ের পরে।/পরশ লেগে দিশে দিশে/ হি হি করে ধানের শিষে/শীতের কাঁপন ধরে।’ অঘ্রাণ বা অগ্রহায়ণ মাস এলেই শীতের তীব্রতা শুরু হতে থাকে। পাতা ঝরা দিনের শুরু হয় তখনই। প্রকৃতিতে নেমে আসে আড়ষ্টতা। হিম করা সন্ধ্যায় থেমে থাকে চারদিক। হেমন্ত এলে পাল্টে যায় প্রকৃতি ও মানুষ। গ্রামের পরিবেশে আনন্দ বিরাজ করে। গ্রাম্য মেলা, ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েশ বানানোর আয়োজন, ঢেঁকির শব্দ সব মিলিয়ে এক অন্যরকম প্রকৃতিকে বরণ করে নেয় হেমন্তে।
ষড়ঋতুর যে দুই ঋতু এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে তার একটি হলো হেমন্ত। বাংলার প্রতিটি ঋতুর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। ভিন্ন ভিন্ন রূপ। সব মিলিয়েই এই বাংলা। বাংলার গান, কবিতা, ছড়া, গল্প বা উপন্যাস সব শাখাতেই ঘুরে ফিরে কম-বেশি সব ঋতুই এসেছে। ঋতু বন্দনা হয়েছে। সত্যি কথা বলতে, বাংলা কবিতায় যেভাবে ঋতুরাজ বসন্ত, বর্ষা বা শরৎ বন্দনা হয়েছে সে তুলনায় হেমন্ত এসেছে কমই। এই উপেক্ষার কোনো যথাযথ কারণ নেই। কারণ সৌন্দর্য এবং বৈশিষ্ট্য লালিমায় কোনো অংশেই কম নয় হেমন্ত। সেই বন্দনায় হেমন্তও কম কিছু নয়।

হেমন্তের মাঠ-ঘাট, শিশির ভেজা সকাল, মাঠের পাকা সোনালি ধান, কৃষকের ধান ঘরে তোলার দৃশ্য, ঘরে ঘরে ডোলা ভর্তি ধান, কৃষক-কৃষাণির আনন্দ সবই হেমন্তের রূপের অনুষঙ্গ। বৈচিত্র্য রূপের সাজে প্রকৃতিতে হেমন্ত বিরাজ করে। হেমন্ত ঋতুতে চলে শীত-গরমের খেলা। হেমন্তের শুরুতে এক অনুভূতি আর শেষ হেমন্তে অন্য অনুভূতি। ভোরের আকাশে হালকা কুয়াশা, শিশিরে ভেজা মাঠ-ঘাট তারপর ক্রমেই ধরণী উত্তপ্ত হতে থাকে। বাংলার চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ীই এদেশ ষড়ঋতুর দেশ। পালা করে প্রকৃতি একে এক তার ছয়টি রূপ আমাদের সামনে আনে। আমরাও অপেক্ষায় থাকি দুই মাস অন্তর অন্তর ঋতুর পালাবদলের।

আমাদের জীবনযাত্রায় এসব ঋতু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের ফসল উৎপাদন এবং ঋতুনির্ভর ফল ঋতু বদলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ভিন্ন বৈচিত্র্যে হাজির হয়। প্রকৃতির বৈচিত্র্যের সঙ্গে আমাদের মনেও বৈচিত্র্য আসে। প্রিয় ঋতুর তালিকায় ভিন্ন মত আছে। তবে সৌন্দর্যের তালিকায় হেমন্তের আলাদা কদর রয়েছে। কারণ হেমন্ত হলো নবান্ন উৎসবের ঋতু। নতুন ধানে ঘরে ঘরে পিঠা-পুলি-পায়েশ তৈরির ধুম এই ঋতুতেই শুরু হয়। অন্য যে কোনো ঋতুর তুলনায় এই ঋতুর বৈশিষ্ট্য একটু বেশি ভিন্ন। কবি সাহিত্যক, গায়কের খাতায় এ ঋতু নিয়ে নানা সৃষ্টিকর্ম উঠে এসেছে। বারো মাস আর ছয় ঋতু এই তো বাংলার প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য।

বাংলা মায়ের নতুন নতুর রূপ তার সন্তানদের মুগ্ধ করে রাখে। তাই তো কবি বলেছেন’ তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী’। ঋতুর পালাবদলে এখন প্রকৃতিতে হেমন্ত এসেছে। শরতের সাদা মেঘের ভেলা এখনো ভাসতে দেখা যায়। বিশেষ করে কার্তিকের আকাশে। প্রকৃতির এই নতুন সাজ বাংলার মানুষের কাছে খুব চেনা। শত বছরের পরিচিত দৃশ্য। বাংলার রূপের নাম হেমন্ত। মাটিতে বিছানো থাকে শিউলি ফুল। কবির কবিতার খাতায় নতুন ছন্দ আসে। গায়কের কণ্ঠে নতুন গানের সুর ওঠে। সে সুর ভেসে যায় বহুদূর পালতোলা নৌকার মাঝির কানে। আনন্দে বৈঠা বেয়ে যায় সে। আশি^ন পেরিয়ে কার্তিক এলেই নবান্নের ধুম পরে যায়। এর পরেই যেহেতু শীতকাল। তাই এ মাস থেকে শীতের আগমনী বার্তা জোরে-শোরেই বোঝা যেতে থাকে।

হেমন্তের হাওয়ায় শীতের প্রবল উপস্থিতি তিনি উপলব্ধি করেছেন। ‘সবুজ ঢেউ’-এর মধ্যে দিয়ে এঁকেছেন ধানক্ষেতে দোলা লাগার অপরূপ ছবি। খেজুর রস, হালকা শীতের মেজাজ, ঘাসের ডগায় শিশিরের অস্তিত্ব, সকালের মিষ্টি রোদ সবকিছুই যেন প্রকৃতির আশীর্বাদ হয়ে আসে আমাদের মাঝে। হেমন্ত এক অপরূপ রূপের ঋতু। যে ঋতুর সঙ্গে মানুষের আনন্দের যোগসূত্র রয়েছে। হাসি-কান্না জড়িয়ে আছে। শতাব্দীকাল ধরেই আমরা কৃষিপ্রধান দেশ। আর এই কার্তিকেই ফসল ঘরে ওঠে। ধান শুকানো, মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় কাটে। বাংলার খুব চেনা রূপ যে তরুণীর কল্পনা করে সে হেমন্ত বৈ আর কোনো ঋতু নয়। সারা বছরের মহাজনের কাছ থেকে ধার নেওয়া পাওনা পরিশোধের সুযোগ হয় ফসল ঘরে ওঠার পরেই। সারা বছরের মুখের অন্নের যোগানও আসে এ সময়। হেমন্ত তাই সুখ-সমৃদ্ধির কাল। তাই মুখের হাসিটা অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশিই থাকে কার্তিকের নবান্নের দেশের মানুষের।

হেমন্ত এক অপরূপা সুন্দরী রমণী। নিজের ওপর এঁকে রাখে কুয়াশার পর্দা। সকাল হওয়ার পর থেকে সেই পর্দা ক্রমশ দৃশ্যমান হয়। কবিগুরু হেমন্তকে তিনি ফসলের ঋতু হিসেবেও দেখেছেন। গানের সুরে তিনি সেই স্তুতি করেছেন। তিনি লিখেছেন- 
হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা/সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে/কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা/ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।/দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।/আপন দানের আড়ালেতে/রইলে কেন আসন পেতে/আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন করে রাখা। হেমন্তের দুই মাস কার্তিক ও অগ্রহায়ণ রূপে আলাদা। শরৎ ও শীত দুইয়েরই দেখা মেলে হেমন্তে। তাই সম্ভবত হেমন্তকে খুব একটা আলাদা করার প্রয়োজন হয় না! বুঝতেও একটু অসুবিধে হয়! কুয়াশা দেখলে আমরা তাকে শীত বলি। হেমন্ত হলো শীতের পূর্বাভাস। গাছের নিচে তাকালেই রঙিন পাতা ঝরে পরার দৃশ্য দেখা যায়। এই শীতের শুরুটাই হলো হেমন্ত যা মূলত অঘ্রাণে ভেসে ওঠে। যেমন বৃষ্টি দেখলে বর্ষা!

কিন্তু কুয়াশার শুরু যে সেই হেমন্তে তা যেন ভুলতেই বসেছি। অঘ্রাণে কুয়াশার মাত্র একটু বেশি দেখা যায়। কবিগুরুর হেমন্ত উপলব্ধি, হেমন্ত নিয়ে আবেগ সুদূর বিস্তৃত। তিনি লিখেছেন, ‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে/জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে/শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার/রয়েছে পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার/স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’ কবি গুরুর হেমন্ত নিয়ে স্বচ্চারিত পঙিমালা, গানের কথা এ সবই হেমন্তের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সৌন্দর্যের রূপকণ্ঠে যোগ করেছে নতুনত্ব, দৃষ্টিপথ আরও সুগম করেছে প্রকৃতিপ্রেমীর।

×