
ছবি: সংগৃহীত
প্রতিদিন সূর্য ওঠে, আবার ডুবে যায়। ঠিক তেমনই একজন বাবা—যিনি নিঃশব্দে প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই ঘর ছাড়েন, এবং যখন সন্তানের চোখে ঘুম নেমে আসে, তখন তিনি ঘরে ফেরেন। এই নিরব আসা-যাওয়ার মধ্যেই জমা হয় অগণিত স্বপ্ন, দায়িত্ব, ত্যাগ আর ভালোবাসার এক অনবদ্য ইতিহাস। বাবা—তিনি কোনো কবিতার বিষয় নন, কোনো উপন্যাসের রোমান্টিক নায়কও নন। অথচ তিনিই হচ্ছেন জীবনের এক জীবন্ত উপাখ্যান, এক চলমান মহাকাব্য।
তিনি মুখে বলেন না “আমি ভালোবাসি”, চোখে জল দেখান না। কিন্তু তিনিই কাঁধে তুলে নেন পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বোঝা—সন্তানের ভবিষ্যৎ। তা তিনি করেন এমন নিঃশব্দে, যেন কিছুই হয়নি। সন্তান যখন বড় হয়, নিজের জীবনের পথে এগিয়ে যায়, তখন বাবা দাঁড়িয়ে থাকেন পেছনে—ভাঙা স্যান্ডেল পায়ে, কাঁধে পুরনো ব্যাগ, আর মনে সন্তানের স্বপ্নের একটা তালিকা।
কুরআনে আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতার অধিকার সম্পর্কে বলেন—
“তোমার প্রতিপালক আদেশ করেছেন যে, তুমি কেবল তাঁরই ইবাদত করো এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো। তাদের একজন বা উভয়েই যদি বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে তাদের ‘উফ’ পর্যন্ত বলো না, তাদের ধমক দিয়ো না এবং তাদের সঙ্গে সম্মানের সঙ্গে কথা বলো।”
(সূরা আল-ইসরা: ২৩)
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, পিতার মর্যাদা কত উচ্চতর। এমনকি বিরক্তির সামান্য ইঙ্গিতও নিষিদ্ধ। অথচ আমাদের অনেকেই বাবার একটু কড়া কণ্ঠে মুখ ভার করি, ফোন কেটে দিই, কিংবা সপ্তাহ পার করে দিই খোঁজ না নিয়েই।
নবী করিম (সা.) এর বাণী:
“তোমার পিতা তোমার জান্নাত অথবা জাহান্নাম।”
(তিরমিযী)
অর্থাৎ, বাবার সন্তুষ্টির ওপর নির্ভর করে সন্তানের চূড়ান্ত পরিণতি। বাবা খুশি হলে জান্নাতের দরজা খুলে যেতে পারে, আর অসন্তুষ্ট হলে মানুষ ধাবিত হতে পারে জাহান্নামের দিকে।
বাবা হচ্ছেন সেই মানুষ, যিনি জীবনের প্রতিটি ধাপে আমাদের হাত ধরে চলতে শিখিয়েছেন। অথচ এক সময় তাঁর সেই হাতটা আমরা ধরতে লজ্জা পাই। তিনি মুখে বলেন না তাঁর প্রয়োজনের কথা, কারণ সন্তানের প্রয়োজনই তাঁর একমাত্র চাওয়া। তিনি না খেয়ে থাকেন, কিন্তু সন্তানের হাসিমুখ দেখলেই তাঁর ক্ষুধা মরে যায়।
এই শহরের অলিগলিতে অসংখ্য বাবা আছেন, যাঁরা রিকশা চালিয়ে, শ্রম দিয়ে, লোকসান গুনেও মুখে হাসি রাখেন—শুধু সন্তানের খরচ ঠিকভাবে পাঠাতে পারবেন কি না, এই চিন্তায়। সন্তান যখন ব্যর্থ হয়, প্রথম যার চোখে জল আসে, সে বাবা। কিন্তু তিনি কাঁদেন না—আকাশের দিকে তাকিয়ে স্রষ্টার কাছে সন্তানের তৌফিক চান।
আজ বাবা দিবস। আমরা অনেকেই উপহার দিই, ছবি দিই ফেসবুকে, একসঙ্গে খেতে যাই। এগুলো ভালো, প্রশংসনীয়। কিন্তু কখনো কি চোখে চোখ রেখে বলেছি—“বাবা, আমি আপনাকে ভালোবাসি” এই একটি বাক্য হয়তো বাবার জীবনের সব ক্লান্তি মুছে দিতে পারে।
আর যাঁদের বাবা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁদের জন্য শ্রদ্ধা ও দোয়া সবচেয়ে বড় উপহার। আজ একটি সূরা ফাতিহা পাঠ করুন তাঁর রূহের মাগফিরাতের জন্য। সেই অশ্রু, যা আপনি চুপিচুপি ফেলবেন বাবার স্মৃতিতে—কিয়ামতের দিন তা সাক্ষী হবে আপনার ভালোবাসার।
বাবাকে ভালোবাসার জন্য কোনো দিবসের প্রয়োজন নেই। তিনি আছেন প্রতিদিন, আমাদের সাফল্যে, ব্যর্থতায়, ক্লান্তির আশ্রয়ে।
তাঁকে ভালোবাসুন, তাঁকে স্মরণ করুন। কারণ বাবা নিজেই এক অপূর্ব উপলক্ষ—একটি নিঃশব্দ ভালোবাসার অনন্ত মহাকাব্য।
ফরিদ