
ছবি: সংগৃহীত
চিরযৌবনের আকাঙ্ক্ষা হাজার বছর পুরনো। প্রাচীন মিশর থেকে শুরু করে আধুনিক হলিউড পর্যন্ত নারীরা বারবার ফিরে গেছেন এক প্রশ্নে—যৌবন কি ধরে রাখা যায়? এখন আধুনিক কসমেটিক সার্জারি যেন সেই প্রাচীন স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে, তবে শর্ত একটাই—আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা থাকতে হবে।
সম্প্রতি মার্কিন টিভি ব্যক্তিত্ব ও ‘কার্দাশিয়ান সাম্রাজ্যের’ কর্ণধার ক্রিস জেনার তার নতুন চেহারায় ইন্টারনেটে আলোড়ন তুলেছেন। ৬৯ বছর বয়সে তাকে দেখে অনেকে বলছেন, যেন তিনি ত্রিশের কোঠায়। যদিও তিনি প্রকাশ্যে কখনও স্বীকার করেননি ঠিক কী কী কসমেটিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছেন, তবে গুজবের অন্ত নেই।
প্রসাধনী শিল্পের পুরনো খেলায় নতুন মোড়
চেহারা ঠিক রাখতে অস্ত্রোপচার নতুন কিছু নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আহত সৈনিকদের পুনরায় স্বাভাবিক চেহারায় ফিরিয়ে আনতে যে প্লাস্টিক সার্জারির শুরু, তা এখন রূপ নিয়েছে বিলিয়ন ডলারের কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন এই সার্জারি অনেকটাই বিলাসবহুল জীবনধারার অংশ হয়ে উঠেছে। নারীদের সৌন্দর্যবোধ ও আত্মপরিচয়ের সাথে এটি গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে।
হলিউড থেকে ইনস্টাগ্রাম—যাত্রা একটাই
৬০-এর দশক থেকে ধীরে ধীরে প্লাস্টিক সার্জারি মূল ধারায় চলে আসে। তখন থেকেই মেরিলিন মনরো, জন ওয়েইনের মতো তারকারা নাকের গঠন বদল, চিবুক প্রতিস্থাপন কিংবা ফেসলিফট করিয়ে পর্দার পেছনে নিজেদের ‘নতুন রূপে’ উপস্থাপন করতেন।
এখন সেই ধারা বহুগুণ বেগবান করেছে ইনস্টাগ্রাম, ফিল্টার ও ইনফ্লুয়েন্সার সংস্কৃতি। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত আপলোডকৃত ছবিগুলো কেবল আগ্রহ নয়, হিংসা আর অনুকরণেরও জন্ম দেয়।
নতুন আদর্শ, পুরনো বৈষম্য
গণমাধ্যম বলছে, ক্রিস জেনার তার সৌন্দর্য ধরে রাখতে এখন পর্যন্ত ১ লক্ষ ৩০ হাজার মার্কিন ডলারেরও বেশি খরচ করেছেন। কেউ কেউ বলছেন, তার সন্তানদের থেকেও এখন তার বয়স কম দেখাচ্ছে।
কিন্তু এই সৌন্দর্যের মূল্য কেবল টাকা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। অনেক তারকাই যেমন কোর্টনি কক্স, অ্যারিয়ানা গ্র্যান্ডে কিংবা মিকি রুর্ক খোলাখুলিই বলেছেন যে এই সার্জারিগুলোর মানসিক প্রভাব অনেক বেশি—পশ্চাতাপ, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, আত্মপরিচয়ের সংকট।
বার্ধক্য নয়, সমাজের অস্বীকৃতি বড় সমস্যা
গবেষকরা বলছেন, এই চিরযৌবনের পেছনের মানসিকতা আসলে একটি সাংস্কৃতিক ‘মৃত্যুভয়’ থেকে আসে। বার্ধক্যকে সম্মান করার বদলে আমরা তা ঢেকে ফেলতে চাই। সমাজ নারীদের বয়সকে এখনো একধরনের ব্যর্থতা হিসেবে দেখে।
বেলা হাদিদের মতো অনেকে এখন বলছেন, তারা তাদের আগের চেহারাই ফিরিয়ে পেতে চান—নিজস্ব জাতিগত পরিচয়, পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য সবই তারা হারিয়েছেন অস্ত্রোপচারের দৌড়ে।
অল্পের পক্ষে অসম্ভব এক সৌন্দর্য
বলা হচ্ছে, ক্রিস জেনার বা তার মতো তারকারা যে ‘যৌবনের নতুন সংজ্ঞা’ তৈরি করছেন, সেটি হয়তো লক্ষ নারীর মাঝে চাওয়ার জন্ম দিচ্ছে, কিন্তু প্রাপ্তির সম্ভাবনা খুবই কম। যে বিশ্বে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে চলেছে, সেখানে কয়জনই বা এই বিলাসিতা বহন করতে পারবেন?
এই সৌন্দর্য এখন কেবল একটি ‘পণ্য’ নয়, এটি একটি ‘অধিকার’—যা কেবল অর্থবানদের জন্যই খোলা। আর এই খোলসের ভিতরেই চলছে সৌন্দর্য দিয়ে নারীদের বিচার—রাজনীতি, সামাজিক অবস্থান, মূল্যবোধ—সবই এখন চেহারার পাল্লায় ওজন করা হয়।
তাই যতদিন না সমাজে সৌন্দর্যকে নারী মূল্যায়নের অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হবে, ততদিন এই চাপ, এই ছলচাতুরি ও এই খরচ—সবই অব্যাহত থাকবে।
সূত্র: দ্য কনভারসেশন।
রাকিব