ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৯ জুন ২০২৫, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ক্যারিয়ারের পথচলায় শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রস্তুতি

রাশেদুল ইসলাম সম্রাট, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ১১:১৫, ৯ জুন ২০২৫

ক্যারিয়ারের পথচলায় শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রস্তুতি

ছবি: সংগৃহীত

প্রত্যেক শিক্ষার্থীর একটি অভিন্ন স্বপ্ন থাকে উচ্চশিক্ষার জন্য একটি গুণগত মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করা। এই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে তারা কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও আত্মনিবেদনের মধ্য দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নতুন যাত্রা শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই মূলত তাদের ক্যারিয়ার গঠনের ভিত্তি তৈরি হতে থাকে।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যারিয়ার বিবেচনায় সাধারণত তিনটি প্রধান লক্ষ্য নিয়ে এগোয়—সরকারি চাকরি, কর্পোরেট ক্যারিয়ার কিংবা বিদেশে উচ্চশিক্ষা। একাডেমিক শিক্ষা মৌলিক যোগ্যতার ভিত্তি গড়ে দিলেও, প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত প্রস্তুতি ও দক্ষতার সংযোজন। সরকারি চাকরির প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বাংলা, গণিত, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞানের উপর পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, কর্পোরেট পেশাজীবন কিংবা বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ইংরেজিতে পারদর্শিতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, গবেষণায় সম্পৃক্ততা এবং খণ্ডকালীন কাজের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় একজন শিক্ষার্থীকে নানাভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়—বিশ্বমানের শিক্ষকের পাঠদান, গবেষণার সুযোগ, আধুনিক ল্যাব ও প্রযুক্তি সুবিধা, এবং এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নেতৃত্ব, টিমওয়ার্ক ও যোগাযোগ দক্ষতা অর্জনের সুযোগ।

এসব সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে অবশ্যই প্রয়োজন নিজস্ব আগ্রহ, আত্মপ্রেরণা এবং সময়ানুবর্তিতার অভ্যাস। যে শিক্ষার্থী নিজেকে আত্মনিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, অলসতা দূর করে প্রতিদিন সময়কে কাজে লাগায়, সে-ই ভবিষ্যতের জন্য সর্বোত্তমভাবে প্রস্তুত হতে পারে।

তবে, সকল শিক্ষার্থীর প্রস্তুতির পথ একরকম নয়। কারও কাছে প্রয়োজনীয় সুযোগ ও সহায়তা থাকলেও, অনেকেই আর্থিক চাপ বা সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে পিছিয়ে পড়ে। ফলে এ প্রতিযোগিতায় সমান সুযোগের বাস্তবতা থেকে যায় অনেক দূরে।

বর্তমান বিশ্বে পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে। টিকে থাকতে হলে শিক্ষার্থীদেরও পরিবর্তিত বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে—নতুন নতুন স্কিল শিখতে হবে, প্রযুক্তির সঙ্গে আপডেট থাকতে হবে এবং সর্বোপরি নিজেদের আত্মবিশ্বাসী ও অভিযোজিত করে তুলতে হবে। যারা এই দক্ষতা অর্জনে মনোযোগ দেয়, তারা কখনো ব্যর্থ হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই থাকে কিছু বড় স্বপ্ন—নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করা। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, দেশের চাকরির বাজার দিন দিন আরও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে উঠছে। প্রতিবছর লাখ লাখ গ্র্যাজুয়েট পাস করলেও তত সংখ্যক চাকরি তৈরি হচ্ছে না। ফলে বেকারত্ব এবং হতাশা বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের মনোজগতে ও নৈতিকতায়।

বাংলাদেশে বেকারত্ব একটি দীর্ঘস্থায়ী ও বহুমাত্রিক সংকট, যা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এটি শুধু ব্যক্তিগত জীবনের সীমাবদ্ধতায় আটকে নেই। দিনশেষে রাষ্ট্র, সমাজ এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকেই এর দায়ভার নিতে হয়। এই সংকটের মূল কারণ হলো কিছু কাঠামোগত ও নীতিগত দুর্বলতা, যা দীর্ঘদিন ধরে অবহেলা এবং যথাযথ সমাধানের অভাবে আজও অমীমাংসিত থেকে গেছে।

• শিক্ষা ও দক্ষতার মাঝে গ্যাপ:

প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশেই কর্মমুখী নয়। ফলে ডিগ্রি থাকলেও চাকরির বাজারে চাহিদাসম্পন্ন স্কিলের অভাব দেখা যায়।

• শিল্প ও কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা:

বড় সংখ্যক শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর তুলনায় দেশে পর্যাপ্ত শিল্প-কারখানা বা কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই।

• জনসংখ্যার চাপ:

কর্মক্ষম জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি চাকরির সুযোগের তুলনায় অনেক বেশি।

• সরকারি চাকরির প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা:

অধিকাংশ শিক্ষার্থী সরকারি চাকরির পেছনে ছোটে, যার সংখ্যা সীমিত—ফলে প্রতিযোগিতা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।

• উদ্যোক্তা মানসিকতার ঘাটতি:

শিক্ষা ব্যবস্থায় উদ্যোক্তা হওয়ার প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা বা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না।

• অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের স্বীকৃতি ও নিরাপত্তাহীনতা:

অনেকেই ক্ষুদ্র বা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে যুক্ত হলেও সামাজিকভাবে তা সম্মানজনক বা স্থায়ী মনে করা হয় না।

দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সার্বিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিচের উল্লেখযোগ্য সমাধানের পথগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে, যা দেশের ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে:

• কর্মমুখী ও স্কিল-বেইজড শিক্ষা চালু করা:

কারিগরি শিক্ষা, সফট স্কিল, আইটি ও ভাষা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক ও যুগোপযোগী করতে হবে।

• উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও স্টার্টআপ সাপোর্ট:

শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ, সরকারি সহযোগিতা, সহজ ঋণ ও পরামর্শ সুবিধা দিতে হবে।

• প্রাইভেট সেক্টরের সম্প্রসারণ:

নতুন শিল্প গড়ে তুলতে হবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়।

• বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো:

স্কিল ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক তৈরি করে বিদেশে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

• ইন্টার্নশিপ ও পার্টটাইম কাজের সুযোগ:

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই ছাত্রদের প্রফেশনাল অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ তৈরি করতে হবে।

• ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও ফ্রিল্যান্সিং সেক্টর উন্নয়ন:

ফ্রিল্যান্সিং, রিমোট জব ও ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে অংশগ্রহণ বাড়াতে সহযোগিতা করতে হবে।

সুতরাং, এটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে—বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত একজন শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে তোলে; কেবল একাডেমিক অর্জনে নয়, বরং নেতৃত্ব, সমস্যা সমাধান, যোগাযোগ দক্ষতা, গবেষণা, প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শিতা এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিটি ধাপে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেকেই এই সুযোগগুলো কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। ফলে ডিগ্রি থাকলেও বাস্তব জীবনের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।

আজকের কঠিন বাস্তবতায়, যেখানে চাকরির বাজার সংকুচিত, সেখানে শুধু ডিগ্রিধারী হওয়াটা যথেষ্ট নয়—প্রয়োজন দক্ষ, উদ্ভাবনী ও উদ্যোমী হয়ে ওঠা। যারা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনকে কেবল একাডেমিক অর্জনে সীমাবদ্ধ না রেখে আত্মউন্নয়ন ও স্বপ্নপূরণের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজে লাগাতে পারে, তারাই আগামী দিনের সম্ভাবনার ঠিকানা খুঁজে পায়।

তাই, নিজেকে গড়ে তোলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রতিটি দিনকে মূল্য দেওয়া এবং একে ফলপ্রসূভাবে কাজে লাগানোই ভবিষ্যতের সফলতার চাবিকাঠি।

মুমু ২

×