
একুশ শতকের শুরুর দিকেই প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিকাশ আমাদের জীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। বর্তমানে মানুষ এক ক্লিকের বদৌলতে সারা বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে। তথ্য, বিনোদন, যোগাযোগ, সবই হাতের মুঠোয়। কিন্তু এই সুবিধার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি।
Statista-এর ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ৫.১৭ বিলিয়ন মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। প্রতিদিন একজন ব্যবহারকারী গড়ে ২ ঘন্টা ২৪ মিনিট সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটায়। বাংলাদেশে সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৫ কোটির বেশি, যার একটি বড় অংশ কিশোর ও তরুণ। এই সংখ্যাগুলো শুধু ব্যবহার নয়, ব্যবহারজনিত নির্ভরতা এবং সময়ের অপচয়ের দিকেও ইঙ্গিত করে।
আসক্তি কী এবং কেন হয়?
আসক্তি বলতে বোঝায় কোনো কিছুতে অতিরিক্ত নির্ভরতা ও সংযম হারিয়ে ফেলা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বারবার প্রবেশ করা, অপ্রয়োজনীয়ভাবে স্ক্রল করা, অন্যের পোস্ট দেখে হীনমন্যতায় ভোগা—এসবই এর লক্ষণ।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন:
সোশ্যাল মিডিয়ার লাইক, কমেন্ট, ফলোয়ার সংখ্যা মানুষের মস্তিষ্কে ‘ডোপামিন’ নামক আনন্দ-উৎপাদক রাসায়নিকের নিঃসরণ ঘটায়। এর ফলে মানুষ স্বল্পমেয়াদী আনন্দে আসক্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে এটি নেশার মতো আচরণে রূপ নেয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসক্তির বহুমাত্রিক প্রভাব
১. মানসিক স্বাস্থ্য: অতিরিক্ত ব্যবহার উদ্বেগ, বিষণ্নতা, একাকীত্ব এবং আত্মসম্মানবোধ হ্রাস ঘটায়। 'FOMO' (Fear of Missing Out) বা সবকিছু মিস করে ফেলার ভয় তৈরি হয়। ভার্চুয়াল জীবনের সঙ্গে বাস্তব জীবনের গড়মিল মানসিক অস্থিরতা বাড়ায়।
২. শারীরিক স্বাস্থ্য: স্ক্রিনে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকার ফলে চোখের সমস্যা, মাথাব্যথা, ঘাড়-পিঠে ব্যথা হতে পারে। রাত জেগে ফোন ব্যবহারে ঘুমের সমস্যা এবং ক্লান্তি দেখা দেয়।অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসে সমস্যা হয়।
৩. শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব: পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হ্রাস পায়, মনোযোগ কমে যায়। ভার্চুয়াল গেম, ভিডিও, চ্যাটের ফাঁদে পড়ে অনেকেই আসক্ত হয়ে পড়ছে। কল্পনার জগতে ডুবে গিয়ে বাস্তব জীবনের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে অনেক তরুণ।
এছাড়াও পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের অবনতি, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যাচ্ছে।বন্ধুদের সঙ্গে বাস্তব মেলামেশার পরিবর্তে ভার্চুয়াল যোগাযোগ প্রাধান্য পাচ্ছে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ব বেড়ে যাচ্ছে।
গবেষণা কী বলছে?
আমেরিকান জার্নাল অফ হেলথ বিহেভিয়ারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দিনে ৩ ঘণ্টার বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে বিষণ্নতার লক্ষণ দ্বিগুণেরও বেশি। ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়ার একটি স্টাডিতে দেখা যায়, ২১ দিনের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার সীমিত করলে মানসিক স্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে।
সমাধানের পথ
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আসক্তি বর্তমান যুগের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সচেতনতা, পরিকল্পনা ও নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে এই আসক্তি থেকে মুক্তি সম্ভব।
১. আত্মবিশ্লেষণ ও সচেতনতা গড়ে তোলা
নিজের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার কতটা, কী উদ্দেশ্যে এবং কত সময় ব্যয় হচ্ছে—তা বিশ্লেষণ করুন। বুঝে ফেলুন, এটি আপনার পড়াশোনা, কাজ, ঘুম বা সম্পর্কের ক্ষতি করছে কি না।
২. নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করুন
প্রতিদিন কতক্ষণ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করবেন, তার একটি সময়সূচি তৈরি করুন (যেমন: সকাল ৩০ মিনিট, রাতে ৩০ মিনিট)। মোবাইল/অ্যাপে Screen Time Tracker বা App Timer ব্যবহার করুন।
৩. ‘নোটিফিকেশন’ বন্ধ করুন
মোবাইল অ্যাপের অপ্রয়োজনীয় ‘পুশ নোটিফিকেশন’ বন্ধ রাখলে অহেতুক বারবার প্রবেশের প্রবণতা কমে যায়। বিশেষ করে রাতের বেলা বা কাজের সময় এই টুলটি কার্যকর।
৪. ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ পালন করুন
সপ্তাহে অন্তত একদিন সম্পূর্ণভাবে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিরতি নিন।‘No Phone Evening’ বা ‘Social Media-Free Sunday’ এর মতো অভ্যাস গড়ে তুলুন।
৫. বিকল্প অভ্যাস গড়ে তুলুন
সোশ্যাল মিডিয়ার সময় কমিয়ে বই পড়া, খেলাধুলা, গান শোনা, ছবি আঁকা, পরিবার বা প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটানো—এসব স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলুন। বাস্তব সম্পর্ক ও যোগাযোগকে অগ্রাধিকার দিন।
৬. ঘুমের আগে মোবাইল ব্যবহার এড়িয়ে চলুন
ঘুমানোর অন্তত ১ ঘণ্টা আগে থেকে মোবাইল ব্যবহার বন্ধ করুন। এতে ঘুমের গুণগত মান বাড়বে এবং মানসিক প্রশান্তিও আসবে।
৭. নিজের লক্ষ্যের প্রতি মনোযোগ দিন
সোশ্যাল মিডিয়ার বদলে আপনার জীবনের আসল লক্ষ্য (শিক্ষা, পেশা, সৃজনশীলতা) স্মরণে রাখুন। একটি লক্ষ্যনির্ভর জীবনযাপন আপনাকে ভার্চুয়াল আসক্তি থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করবে।
৮. পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে পরিবর্তন আনুন
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একসাথে খাবার খাওয়া, আড্ডা দেওয়া, টিভি না দেখে গল্প শোনা—এসব সময় মোবাইল মুক্ত রাখুন। বন্ধুদের সঙ্গে বাস্তবে দেখা করার অভ্যাস গড়ে তুলুন, শুধু ভার্চুয়াল চ্যাটেই সীমাবদ্ধ থাকবেন না ।
১০. পেশাদার সহায়তা গ্রহণ
যদি আপনি মনে করেন নিজের পক্ষে এই আসক্তি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, তাহলে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নিতে পারেন।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করুন, তবে তা যেন আপনাকে ব্যবহার না করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একদিকে আমাদের বিশ্বকে কাছে এনেছে, অন্যদিকে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সময় ও মানসিক শান্তির অপূরণীয় ক্ষতি করছে। প্রয়োজন এখন ভারসাম্য রক্ষা করার। প্রযুক্তির ব্যবহার যেন হয় চাহিদা ও প্রয়োজনে। ডিজিটাল সংযুক্তি থাকুক, তবে মানবিক সম্পর্কই থাকুক আমাদের জীবনের মূল ভিত্তি।
আঁখি