
বিশ্ব অর্থনীতিতে দ্রুত পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো স্বয়ংক্রিয়তা (Automation) ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-এর ক্রমবর্ধমান ব্যবহার। McKinsey Global Institute (২০২৩) অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে AI ও রোবোটিক্স প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্ব জিডিপিতে প্রায় ১৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতার উন্নতির ফলে উৎপাদন খরচ কমছে এবং উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এর ফলে চাকরির বাজারে চাপ তৈরি হচ্ছে; বিশ্বব্যাংক (২০২২)-এর মতে, আগামী এক দশকে ৮৫ মিলিয়ন চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে, যদিও নতুন প্রযুক্তিনির্ভর ৯৭ মিলিয়ন চাকরির সুযোগ তৈরি হবে, যেখানে নতুন ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশের জন্য এই পরিবর্তনের প্রভাব মিশ্র। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প, যা মোট রপ্তানির ৮৪% (BGMEA, ২০২৩)। কিন্তু অটোমেশন ও AI প্রযুক্তির প্রসারে শ্রমনির্ভর এই খাতে চাকরির সংখ্যা হ্রাসের শঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে, AI বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। a2i (২০২৩) অনুসারে, বাংলাদেশের প্রায় ৬.৫ লাখ ফ্রিল্যান্সার বৈশ্বিক বাজারে কাজ করছেন। কৃষিক্ষেত্রেও AI-এর সম্ভাবনা রয়েছে—BRAC (২০২২) এর গবেষণায় দেখা গেছে, স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষি উৎপাদনশীলতা ২০-৩০% পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।
তবে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গেই ডিজিটাল বৈষম্য (Digital Divide) একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। OECD (২০২৩)-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে এখনো প্রায় ৩ বিলিয়ন মানুষ ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে। UNDP (২০২২) দেখিয়েছে, মহামারির সময় উন্নত দেশগুলো অনলাইন শিক্ষা ও দূরবর্তী কর্মপদ্ধতি সহজে গ্রহণ করতে পারলেও, উন্নয়নশীল দেশে ডিজিটাল অবকাঠামোর অভাবে লাখো শিক্ষার্থী ও পেশাজীবী পিছিয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার ৪৫% (BTRC, ২০২৩), তবে গ্রামীণ এলাকায় মাত্র ৩০%, যা অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়াচ্ছে। প্রায় ৬০% মানুষ ডিজিটাল সাক্ষরতার বাইরে (বিশ্বব্যাংক, ২০২২)। তবে ফিনটেক খাতে অগ্রগতি লক্ষ্যণীয় bKash ও Nagad-এর মতো সেবার মাধ্যমে প্রায় ৫ কোটি মানুষ ডিজিটাল আর্থিক লেনদেনে অংশগ্রহণ করছে (বাংলাদেশ ব্যাংক, ২০২৩)।
গ্লোবাল ভ্যালু চেইন (GVC) বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৭০% নিয়ন্ত্রণ করছে (WTO, ২০২৩)। বিভিন্ন দেশে উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ বিভক্ত হওয়ার ফলে GVC গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবে COVID-19 মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে GVC-তে বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে (IMF, ২০২৩)। বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে GVC-এর নিম্নস্তরে অবস্থান করছে, যেখানে প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে মূল্য সংযোজন কম (বিশ্বব্যাংক, ২০২২)। "চীন+১" নীতির ফলে বাংলাদেশের জন্য নতুন বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হলেও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংকের লজিস্টিকস পারফরম্যান্স ইনডেক্স (২০২৩)-এ বাংলাদেশের অবস্থান ১০০তম। বন্দর, কাস্টমস ও অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়া GVC-তে বাংলাদেশের অবস্থান উন্নয়ন সম্ভব নয়।
সার্বিকভাবে, প্রযুক্তির অগ্রগতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে, তবে এর সঙ্গে কিছু চ্যালেঞ্জও নিয়ে আসছে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই পরিবর্তনের দিকে নজর দিতে হবে এবং সঠিক নীতি গ্রহণ করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে সকল শ্রেণীর মানুষ প্রযুক্তির সুবিধা পেতে পারে।
আঁখি