ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৯ জুন ২০২৫, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রাজনীতির মাঠে তরুণদের নেতৃত্ব: মুক্তি নাকি পুনরাবৃত্তি?

সোহানুর রহমান, শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ

প্রকাশিত: ১২:০৭, ৯ জুন ২০২৫

রাজনীতির মাঠে তরুণদের নেতৃত্ব: মুক্তি নাকি পুনরাবৃত্তি?

ছবি: সংগৃহীত

রাজনীতি কি কেবল ক্ষমতা আর সুবিধাভোগীদের খেলা? তরুণদের জন্য রাজনীতি কি আদৌ নিরাপদ কিংবা প্রয়োজনীয়? তারা কি পরিবর্তন আনবে, নাকি নিজেরাও একসময় 'পুরনো'দের মতো হয়ে যাবে? এই প্রশ্নগুলো আজ মানুষের মুখে মুখে। কারণ, একদিকে আমরা দেখছি ছাত্রদের সাহসী জাগরণ, অন্যদিকে দেখছি সেই ছাত্রনেতারাই কয়েক দশক পর হয়ে উঠছেন দুর্নীতিগ্রস্ত, সুবিধাবাদী নেতা। তাহলে জনগণ কাকে বিশ্বাস করবে?

বিশ্বাস করব সেই চেতনাকে, যা ২০২৪ সালের জুলাইয়ে রাজপথে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীরা দেখিয়েছে। কিন্তু বিশ্বাসের পাশাপাশি চাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। কারণ, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে এগুলো ছাড়া উন্নয়ন কেবল কাগজে লেখা স্বপ্নই থেকে যাবে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্রদের ভূমিকা কেবল গৌরবোজ্জ্বলই নয়, বরং তারা ছিল পথ প্রদর্শকের ভূমিকায়। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা বুকের রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিল। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনেও ছাত্রসমাজ ছিল নেতৃত্বে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের বিপ্লবী জাগরণই স্বৈরাচারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। আর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্ররা কেবল স্লোগান নয়, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। সেই ধারাবাহিকতা ২০২৪ সালেও বিদ্যমান। শিক্ষার্থীরা এখনো রাজপথে—নিরাপদ সড়ক, দুর্নীতি বিরোধিতা ও শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের দাবিতে সোচ্চার।

তবে ইতিহাসে এই সোনালি ভূমিকার পাশাপাশি আছে একটি কঠিন প্রশ্ন—যারা একসময় ছাত্রনেতা ছিলেন, তারা কি পরে সৎ রাজনীতিক হতে পেরেছেন? বাংলাদেশে বহু জনপ্রিয় নেতা যাত্রা শুরু করেছিলেন ছাত্র রাজনীতি দিয়ে। কিন্তু সময়ের সাথে তাদের অনেকে হয়ে উঠেছেন বিতর্কিত, দুর্নীতিতে জড়ানো, ক্ষমতার অপব্যবহারে অভিযুক্ত ব্যক্তি। তাদের অতীতের আদর্শিক চেতনা হারিয়ে যায় সুবিধাবাদ ও রাজনীতির কৌশলে।

এই বাস্তবতা আমাদের প্রশ্ন করতে বাধ্য করে—তরুণরা যখন নেতৃত্বে আসে, তখন আমরা কি সত্যিই আশাবাদী হতে পারি? এই জায়গায় ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্রদের জাগরণ কিছুটা আশার আলো দেখায়। কারণ, তারা দলমত নির্বিশেষে একটি যৌক্তিক দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল এবং শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করেছিল। তবে এই আশা ধরে রাখতে হলে চাই নীতিগত অবস্থান, আদর্শিক জবাবদিহিতা এবং সবচেয়ে বেশি দরকার স্বচ্ছতা। কারণ, বাংলাদেশে দুর্নীতির শেকড় এত গভীর যে রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া কোনো পরিবর্তন টিকবে না।

বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতিতে রাজনীতিকরা অনেক সময়েই জনসংযোগহীন, দলে বিভক্ত এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েন। অন্যদিকে ছাত্র নেতৃত্ব সাধারণত হয় ইস্যুভিত্তিক, আদর্শিক এবং তৃণমূলে সংযুক্ত। বিশ্বের বহু দেশেই যেমন—হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, গ্রেটা থুনবার্গের পরিবেশ আন্দোলন—তরুণরাই রাজনীতিতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনেছে।

অনেকেই প্রশ্ন করেন, অন্য দেশের শিক্ষার্থীরা যখন পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার গঠনে ব্যস্ত, তখন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা কেন রাজনীতিতে? কারণ, এই দেশে রাজনীতি থেকে দূরে থাকা মানে নিজের ভবিষ্যৎ থেকে দূরে থাকা। শিক্ষা, চাকরি, বাসস্থান—সবকিছুই রাজনীতির সিদ্ধান্তে প্রভাবিত। তাই তারা রাজনীতিকে জীবনের অংশ মনে করে এবং অনেক সময় বাধ্য হয়েই তাতে অংশ নেয়।

তবে সমস্যা দেখা দেয় যখন ছাত্র রাজনীতি দলীয় দখলে চলে যায়। তখন আদর্শ নয়, বরং ক্ষমতা, দখল ও সুবিধা মুখ্য হয়ে ওঠে। অনেকে বলেন—যেখানে রাজনীতি এতটাই নোংরা ও দুর্নীতিপরায়ণ, সেখানে তরুণদের তাতে না জড়ানোই ভালো। কিন্তু তরুণরা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে পরিবর্তনের সম্ভাবনাটাই মুছে যাবে।

ছাত্রদের রাজনীতি মানে সবসময় দলীয় রাজনীতি নয়। এটি হতে পারে নাগরিক সচেতনতা, নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণ অথবা স্বেচ্ছাসেবামূলক নেতৃত্ব। যদি প্রচলিত রাজনীতি ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই ব্যবস্থাকে ভাঙার দায়ও তরুণদের। বাংলাদেশে অনেক সময় বয়স্ক রাজনীতিকরা তরুণদের নেতৃত্বে আস্থা রাখতে চান না। তারা মনে করেন, অভিজ্ঞতা ছাড়া নেতৃত্ব হয় না। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে—যে নেতৃত্ব সাহস, সততা ও দূরদর্শিতায় ভরা, তা বয়সের চেয়ে বেশি জরুরি। তরুণরা অনেক সময়ই বয়স্কদের চেয়ে বেশি যুক্তিনিষ্ঠ, প্রযুক্তিবান্ধব ও পরিবেশ-সচেতন। তাদের শুধু সুযোগ দেওয়া দরকার।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তরুণদের হাতে—এ কথা শুধু কথার কথা নয়, এটি বাস্তব সত্য। তবে সেই তরুণদের হাতেও যদি স্বচ্ছতা না থাকে, যদি তারাও একসময় ক্ষমতালোভী হয়ে ওঠে, তাহলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে। তাই ছাত্র রাজনীতিকে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি নিরপেক্ষতা, আদর্শ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বাস করতেই হবে—কারণ, ২০২৪ সালের ছাত্র জাগরণ আমাদের দেখিয়েছে, তরুণরা এখনো আদর্শের পথে হাঁটতে পারে। তবে সেই বিশ্বাস টিকিয়ে রাখতে হলে চাই একটি স্বচ্ছ, শক্তিশালী ও জনমুখী ছাত্র নেতৃত্ব, যারা দেশকে কেবল নেতৃত্বই নয়, একটি বিকল্প ভবিষ্যৎও উপহার দিতে পারবে।

লেখক: সোহানুর রহমান শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আসিফ

×