
.
সামনেই শান্তার অনার্স ফাইনাল। রাত জেগে পড়ছে। ক্লান্তি লাগলে ফেসবুকে একটুখানি উঁকি দেয়। একদিন মধ্যরাতে একটা ম্যাসেজ আসল। অচেনা প্রোফাইল বলে দেখল না। পরের দিন আবারও। পড়ে রেখে দিল। পরপর ৩/৪ দিন আসার পর শান্তা উত্তর দিল। রাতে কয়েকদিন টুকটাক কথা বলে ভালোই লাগছিল। পরীক্ষা শেষ হলো। এর মধ্যে তাদের মাঝে আন্তরিকতাও বাড়ল। ২/১ দিন ভিডিও কলেও কথা হয়েছে। বেশ সুদর্শন ফয়সাল। কথা বলে সুন্দর করে। ছোটখাটো ব্যবসা করছে। একদিন তারা দেখা করবে বলে ঠিক করে। দেখার পর শান্তার তাকে আরও ভালো লাগলো। ৩ মাসের পরিচয়ে তাদের ঘনিষ্ঠতাও বাড়লো। এখন বিয়ে করবে বলে ভাবছে। মাস্টার্সটা বিয়ের পরই করবে। ফয়সাল এবার প্রস্তাব করল দুজন দূরে কোথাও বেড়াতে যাবে। শান্তা প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও ফয়সালের ভালোবাসার টান তাকে ফেরাতে পারল না।
বান্ধবীর বাসায় থাকবে বলে বের হয়। এরপর তারা অবৈধ সম্পর্কে জড়ালো। শান্তা এবার বিয়ের কথা তুলল। এভাবে সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার কি দরকার! তারা তো যে কোনো সময় বিয়ে করতেই পারে। ফয়সাল বিয়ের বিষয়টি এড়িয়ে যেতে থাকল। শান্তার মনে খটকা লাগল। এক সময় তাদের মধ্যে এ নিয়ে ঝগড়ার সৃষ্টি হলো। দূরত্বও বাড়ল। ফয়সাল তাকে ব্ল্যাকমেইল শুরু করল। গোপনে কখন তাদের অবৈধ সম্পর্কের ভিডিও করেছে, শান্তা তা জানতেও পারেনি। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবে বলে ভয় দেখিয়ে আরও কয়েকদিন তার সঙ্গে সম্পর্কে জড়াল এবং টাকাও চাইল। প্রথম ২/১ বার কিছু টাকায় সুরাহা হলেও, পরে আর পারল না। ফয়সাল তা ছড়িয়ে দিল ফেসবুকে।
ঘটনাটা কাল্পনিক হলেও এমন ঘটনা বাস্তবে ঘটছে। ফয়সালের মতো এমন প্রতারকদের ফাঁদে পড়ে অনেক শান্তা সর্বশান্ত হচ্ছে। এখানে তো একটা সাদামাটা ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এর চেয়ে ভয়ানক ঘটনাও ঘটছে। পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বারবার এসব ঘটনা উঠে আসলেও সতর্ক হচ্ছে না কেউ। ফয়সালদের এমন ফাঁদে আটকে পড়ছে অনেক মেয়েই। কেন ঘটছে এসব! পারিবারিক মূল্যবোধ বা ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব? নাকি ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা? আসলে কোনো একক বিষয়কে দায়ী করা যায় না। সবকিছুই একসঙ্গে জড়িত। এ যুগের ছেলেমেয়েরা ধর্মীয় অনুশাসন সম্পর্কে অজ্ঞ, পাশাপাশি পারিবারিক মূল্যবোধেরও অভাব রয়েছে, তৈরি হচ্ছে না কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা আর তার বিধিনিষেধের অভাবে তারা অনভিপ্রেত দুনিয়ায় প্রবেশ করছে। এসবের ভালো-মন্দ দিক সম্পর্কে না জানায় তারা অশ্লীলতায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। আর লিপ্ত হচ্ছে নানা অপকর্মে। অ্যাডভোকেট আরফান সুলতানা জানান, ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যেতে হলে আমাদের শুরুতেই ধর্ষণের আইনী সংজ্ঞা নিয়ে বলতে হয়। দ-বিধি ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় ‘ধর্ষণ’কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী স্পেসিফিকভাবে পাঁচটি অবস্থায় শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ধর্ষণ হবে বলে গণ্য করা হয়েছে-
১। নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে,
২। নারীর সম্মতি ছাড়া,
৩। মৃত্যু কিংবা জখমের ভয় দেখিয়ে নারীর সম্মতি নিয়ে,
৪। নারীর সম্মতি নিয়েই, যেক্ষেত্রে পুরুষটি জানে যে সে ঐ নারীর স্বামী নয় এবং ঐ নারীটি তাকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে যে পুরুষটির সঙ্গে তার আইনসঙ্গতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে সে বিশ্বাস করে।
৫। নারীর সম্মতিসহ বা সম্মতিছাড়া- যদি সে নারীর বয়স ১৪ বছরের কম হয়।
এরপর আসা যাক বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের পর কোনো ছবি, ভিডিও, কল রেকর্ড ফাঁস করা বা করার জন্য হুমকি প্রদান করা এবং এতদসূত্রে কোনো লেনদেনে ভিকটিমকে বাধ্য করা। এরূপ হুমকি প্রদানের ক্ষেত্রে ভিকটিম দণ্ডবিধি ৩৮৩ (ক) তে মামলা দায়ের করতে পারেন। এছাড়াও পেনাল কোড অনুয়ায়ী মানহানির মামলা করতে পারেন। এসকল ডিজিটাল রেকর্ড যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে মানহানি করা হয় তবে অনলাইনে ফেসবুক বা অন্য যেকোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা যেকোনো ওয়েবসাইটে যদি মানহানিকর ছবি বা বক্তব্য প্রকাশ করা হয় তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ২৯ ধারার অধীনে মামলা করা যায় এবং পুলিশ এ ধারার অভিযোগে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারও করতে পারে। অর্থাৎ মানহানিকর বক্তব্য যদি অনলাইনের বাইরে হয় তাহলে এক ধরনের অপরাধ আর অনলাইনে হলে আরেক ধরনের অপরাধ। মানহানি অনলাইনে হলে তার জন্য সাইবার মামলা দায়ের করা যায় এবং মামলা প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তির ৩ (তিন) বছরের কারাদণ্ড ও ৫ (পাঁচ) লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি পুনরায় একই অপরাধ করেন তবে ৫ (পাঁচ) বছরের কারাদণ্ড ও ১০ (দশ) লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দন্ডিত হবেন।’
তবে এ ধরনের ঘটনা যে শুধু মেয়েদের সঙ্গেই হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। ছেলেরাও শিকার হচ্ছেন এ ধরনের প্রতারণায়। তাহলে কি কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না? কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানো যাবে না? অবশ্যই যাবে। কিন্তু কয়েকদিনের পরিচয়েই অবৈধ সম্পর্কে জড়াবেন না। জানুন, বুঝুন, সময় নিন। তবে সবচেয়ে নিরাপদ সম্পর্ক হচ্ছে বিয়ে। প্রেম চিরন্তন, শাশ্বত, পবিত্র। এক সময় প্রেমের সম্পর্কে ছিল অগাধ শ্রদ্ধা, যা পরস্পরকে সম্মানিত করত। কতিপয় মন্দ লোকের ফাঁদে পড়ে এখন তা কলুষিত হচ্ছে। আবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে শাসন করুন।
পরিবার হচ্ছে সবচেয়ে বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেখানে ধর্মীয় অনুশাসন সম্পর্কে ছেলেমেয়েদের শিখাতে হবে। পারিবারিক মূল্যবোধ সম্পর্কে জানাতে হবে। সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কেও সচেতন করতে হবে। পরিবার থেকে যদি একজন মানুষ সঠিক মূল্যবোধ নিয়ে বড় হয়, তাহলে তাদের ভুল পথে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এসব প্রতারণার শাস্তি তো রয়েছেই। কিন্তু সবার আগে দরকার নিজেদের সচেতনতা। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নর-নারী যদি নিজেদের এই মোহ থেকে বিরত রাখতে না পারে, তাহলে কোনো আইনই এসব অপকর্ম কমাতে পারবে না। তাই সচেতন হোন।
ছবি : এস কে জায়েদ