ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২

আলোর খোঁজে

মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ২২ জুন ২০২৫

আলোর খোঁজে

রূপার হাতে চিঠিটা কাঁপছিল। বছরের পর বছর অপেক্ষার পর আজ এসেছে সেই চিঠি যার জন্য সে প্রতিদিন ডাকপিয়নের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। পুরানো খামের উপর লেখা ঠিকানা দেখে তার মনে পড়ে গেল সেই সন্ধ্যার কথা, যেদিন করিম ভাই তাদের পাড়া ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তখন রূপার বয়স মাত্র বারো, কিন্তু সেই বিদায়ের দৃশ্য আজও তার চোখের সামনে ভাসে।

করিম ভাই ছিল পাড়ার সবার প্রিয় মানুষ। রিকশা চালিয়ে সংসার চালাত, কিন্তু সন্ধ্যা হলেই পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসত পড়াশোনার জন্য। গণিত, বাংলা, ইংরেজি - সব বিষয়েই তার দখল ছিল অসাধারণ। রূপা তখন ক্লাস সেভেনে পড়ত, আর করিম ভাইয়ের কাছ থেকেই সে শিখেছিল কীভাবে কঠিন অঙ্কের সমাধান করতে হয়। কিন্তু একদিন সকালে উঠে দেখল, করিম ভাইয়ের ঘরে তালা ঝুলছে। পাড়ার লোকজন বলল, রাতের অন্ধকারে চলে গেছে কোথায় যেন।

চিঠিটা খুলে রূপা পড়তে শুরু করল। করিম ভাই লিখেছে, "রূপা, তুমি নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছ এতদিনে। আমি জানি তুমি অবাক হয়েছ কেন আমি হঠাৎ চলে গিয়েছিলাম। আসলে আমার একটা স্বপ্ন ছিল - একটা স্কুল খোলার। যেখানে গরিব ছেলেমেয়েরা বিনামূল্যে পড়াশোনা করতে পারবে। সেই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়েছিলাম দূর গ্রামে।" রূপার চোখ ভিজে এল। সে বুঝতে পারল, করিম ভাই তার স্বপ্নের জন্য সবকিছু ত্যাগ করেছিল।

চিঠিতে আরও লেখা ছিল, "আমার স্কুল এখন চালু হয়েছে। পঞ্চাশটা ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছে। কিন্তু আমার একটা শিক্ষক দরকার। তুমি কি আসবে আমার কাছে? তুমি এখন নিশ্চয়ই গ্র্যাজুয়েট হয়ে গেছ। আমার বিশ্বাস, তুমি এই গরিব বাচ্চাদের জীবনে আলো ছড়িয়ে দিতে পারবে।"

রূপা জানালার দিকে তাকাল। বাইরে সন্ধ্যা নামছে, আর রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে অনেক স্কুল পড়ুয়া। তার মনে পড়ল, কলেজ থেকে বের হয়ে সে চাকরির খোঁজ করছিল। কিন্তু করিম ভাইয়ের চিঠি পড়ার পর তার মনে হল, এইতো তার আসল ডাক। শুধু চাকরি নয়, একটা মহৎ কাজের সুযোগ।

পরের দিন সকালে রূপা তার মাকে বলল, "আমি করিম ভাইয়ের কাছে যাব।" মা প্রথমে বাধা দিলেও পরে বুঝতে পারল, মেয়ের সিদ্ধান্ত ঠিক। রূপা জানত, এই সিদ্ধান্ত তার জীবন বদলে দেবে। কিন্তু করিম ভাইয়ের মতো সে চেয়েছিল অন্ধকারে আলো জ্বালাতে।

এক সপ্তাহ পর রূপা পৌঁছাল সেই দূর গ্রামে। করিম ভাইকে দেখে তার চোখ জলে ভরে গেল। বয়স হয়েছে তার, চুলে পাক ধরেছে, কিন্তু চোখে সেই একই স্বপ্নের আলো। স্কুলটা দেখে রূপার মুগ্ধতার সীমা রইল না। মাটির দেয়াল, টিনের চাল, কিন্তু ভেতরে বসে আছে অসংখ্য শিশু, যাদের চোখে শিক্ষার তৃষ্ণা।

"রূপা," করিম ভাই বলল, "তুমি এসেছ বলে আমার স্বপ্ন পূর্ণ হল। এখন আমরা দুজনে মিলে এই শিশুদের জীবনে সত্যিকারের আলো ছড়িয়ে দেব।" রূপা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। সে বুঝতে পারল, জীবনের আসল সার্থকতা টাকা-পয়সায় নয়, বরং অন্যের জীবনে আলো ছড়ানোতে।

সেদিন সন্ধ্যায় রূপা তার প্রথম ক্লাস নিল। ছোট্ট একটা মেয়ে তার কাছে এসে বলল, "আপা, আমি বড় হয়ে ডাক্তার হব।" রূপার মনে হল, এইতো তার জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার। করিম ভাইয়ের মতো সেও এখন আলোর দিশারী।

আঁখি

×