ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মিমের ‘বাগান বিলাস’ শিল্পের সমাহার

শিউলী আহমেদ

প্রকাশিত: ০১:৩৪, ৯ জুন ২০২৩

মিমের ‘বাগান বিলাস’ শিল্পের সমাহার

চট্টগ্রাম বহদ্দারহাটের মেয়ে নুসরাত সুলতানা মিম

চট্টগ্রাম বহদ্দারহাটের মেয়ে নুসরাত সুলতানা মিম। মহসিন কলেজে রসায়ন নিয়ে পড়ছেন, সম্মান দ্বিতীয় বর্ষে। পাশাপাশি ফৌজদার হাট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিওথেরাপি নিয়েও ডিপ্লোমা করছেন। ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে চিকিৎসক হবেন। সে স্বপ্নে বাধা পড়ায় ফিজিওথেরাপিস্ট হয়ে স্বপ্নটা কিঞ্চিৎ বাস্তবায়ন করতে চান। সঙ্গে এই অল্প বয়সে আরও বিশাল স্বপ্নপূরণের কর্মযজ্ঞে নেমেছেন মিম। মিষ্টি মুখের মিম ঘরে ভীষণ অগোছালো হলেও, জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছেন এই বয়সেই। ২০২০ সালের উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু কোভিডের কারণে পড়াশোনায় বিঘœ ঘটে, আর সে বছর অটোপাস দেওয়া হয়।

দীর্ঘ বিরতির কারণে ঘরে বসে সময় কাটছিল না। বন্ধু তৌফিক এসে প্রস্তাব করল কিছু একটা করার। ব্যতিক্রম কিছু। ঘর থেকে গাছ আর মাটির টব নিয়ে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে দুই বন্ধু মিলে শুরু করলেন যাত্রা। সত্যিই ব্যবসা হবে, আয় করবে তেমনটাও ভাবেননি। অনেকটা অপরিকল্পিত ভাবেই শুরু করা। কিন্তু সাড়া পেয়ে গেলেন বেশ। সঙ্গে মাটির জিনিসগুলোর প্রতি ভালোলাগাও তৈরি হয়ে গেল। ব্যস, যাত্রা শুরু। এ যাত্রাপথের নাম দিলেন ‘বাগান বিলাস’। জানতে চাইলাম এতকিছু রেখে মাটির জিনিসই কেন! আরও তো কত রকম পণ্য ছিল, সাধারণত সবাই যা করে। মিম বলেন, ‘ইউনিক+আকর্ষণ+দেশীয় পণ্য- এই তিন নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে।

যেহেতু প্রতিযোগিতামূলক বাজার, তাই ব্যতিক্রমী পণ্য রাখার চেষ্টা করি’। পড়াশোনার এত চাপের মাঝেও বাগান বিলাসের কাজ মিম ঠিকই করে যান। মিম জানান, ‘ক্লাসে যাওয়া-আসার সময়, ক্লাসের ফাঁকে যে অবসর সময়টুকু পাই, তখন ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলি, পণ্যের পোস্ট করা, অর্ডার নেওয়া, কুরিয়ারে যোগাযোগ করা থেকে শুরু করে সবকিছুর ব্যবস্থা করি। আর কাছাকাছি কোথাও পণ্য পৌঁছানোসহ বাকি কাজটুকু তৌফিকই সামলায়।’ এত স্পর্শকাতর জিনিস, সামান্য অসাবধানেই ভেঙে যেতে পারে। তাই পণ্যের পেকেজিংয়ের কাজটাও তারা নিজেরাই করে থাকেন, যাতে পণ্যের কোনো ক্ষতি না হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তারা তাদের পণ্য ডেলিভারি দিয়ে থাকেন। তবে শর্ত দেওয়া থাকে যদি কোনো পণ্য ভেঙে যায় তারা ডেলিভারি খরচসহ আবার পাঠিয়ে দেন। 
প্রথমদিকে অর্ডার পেলে পণ্য আনতেন। এখন তাতে কুলাতে পারেন না। তাই আকর্ষণীয় সব ডিজাইনগুলো এনে স্টক করেন। তবে এখন শুধু অনলাইনেই বিক্রি হয় না, ক্রেতারা এসে দেখে কিনে নিয়ে যান। অনেক দূর-দূরান্ত থেকেও লোকজন আসে পণ্য নিতে। প্রথম মাসে হাজার/১২ শত টাকা বিক্রি হলেও এখন ৩০-৫০ হাজার টাকা বিক্রি হয়।
দেড় বছরে এর লাভ থেকে হালি শহরের বিডিআর মাঠে দিয়েছেন একটি ফুড   কোর্ট, ‘টোনাটুনি’। সুন্দর সাজানো একটি ভ্যান, সেখানেই বিক্রি হয় খাবার- বিকেল থেকে রাত। ঘুরতে আসা মানুষগুলো খায় তৃপ্তি সহকারে। খাবারের মান বজায় রাখতে নিজেরাই বাজার করে দেন। দুজন রাধুনীও রেখেছেন সেখানে, তারা সঙ্গে সঙ্গেই আলু পুরি, ফুচকা, চটপটি, অনথন, রোল, শর্মা তৈরি করে দেন। সেটা দেখাশোনার জন্য রেখেছেন আরও দুই বন্ধুকে। ব্যবসায়ী বাবার মেয়ে, ব্যবসাটাকে ভালোবেসেই গ্রহণ করেছেন। 
তাই অন্যের জন্যও কর্মসংস্থান করে দিতে পেরেছেন। ইচ্ছে আছে একটি আউটলেট দেওয়ার। জানতে চাইলাম, এত অল্প বয়সে ব্যবসায় নামতে পরিবার থেকে বাঁধা আসেনি মিম বলেন, ‘পরিবার থেকে সবাই খুব উৎসাহ দিয়েছেন। না হয় ছাত্রাবস্থায় এতটা করা সম্ভব হতো না। শুধু বলেছেন, পড়াশোনার যেন ক্ষতি না হয়। তোমার ভালো তুমিই বুঝবে।’ মাতৃহীন তৌফিক আর মিম কারোই সংসার চালানোর কোনো চাপ নেই। দুই বন্ধু ঝোঁকের মাথায় শুরু করে মাটির এই ইউনিক পণ্যের ভালোবাসায় জড়িয়ে গেছেন। শুধু ঘর সাজানোর পটারি, ফুলদানিই নয়- হাঁড়ি-পাতিল, প্লেট-বাটি, কাপ-পিরিচ, জগ, পানির ফিল্টারসহ সংসারের প্রয়োজনীয় সমস্ত রকমের তৈজসপত্র পাওয়া যায় এই বাগান বিলাসে। পড়াশোনা আর কাজ দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের। এ নিয়ে মিম জানালেন, ‘পড়াশোনা শেষ করব, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অবশ্যই নিব। চাকরির প্রতি আকর্ষণ নেই, তবে যদি কখনো ভালো চাকরির সুযোগ হয়, ভেবে দেখব। ব্যবসা থাকবে। একে আমি ছড়িয়ে দিতে চাই সারাদেশে।’ ইতোমধ্যে দেশের বাইরেও গেছে তাদের এই পণ্য। এভাবেই ছড়িয়ে যাক স্বপ্নগুলো। 
বন্ধু, পরিবার পাশে থাকলে দুনিয়াটা একটা মেয়ের হাতের মুঠোয়। পড়াশোনা করে ভালো চাকরি করব- এই লক্ষ্য বাদ দিয়ে সবাই যদি মিমের মতো নিজেকে শিক্ষিত করার পাশাপাশি এমন উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে দেশ একদিন সত্যি সমৃদ্ধ হবে। কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হবে।

×