ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২

রেজা নওফল হায়দার

ঘর সাজাতে দেশীয় উপকরণ

প্রকাশিত: ১১:১৮, ৫ এপ্রিল ২০১৯

 ঘর সাজাতে দেশীয় উপকরণ

আমাদের ঘরটাকে আমরা সবাই মনের মতো করে সাজাতে চাই। যে যাই বলুক না কেন দিনের শেষে একটা সুন্দর, ছিমছাম আর পরিপাটি ঘর সবার কাম্য। ঘর সুন্দর করে সাজাতে বা ঘরের সাজে একটু নান্দনিকতার ছোঁয়া আনতে দেশীয় পণ্যের কোন জুড়ি নেই। আপনি নানাভাবে ঘরের সাজে দেশীয় পণ্যের ছোঁয়া আনতে পারেন। বাংলার বুকজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ঘর সাজানোর উপাদান। সৌন্দর্য আর গুণের মিশেলের এসব উপাদান বাছাই করে তুলে এনে সাজানো যায় ঘর। এ ক্ষেত্রে আমরা কী কী ধরনের উপাদান বেছে নিতে পারি এবং সেসব উপাদান কীভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে তা ভাবতে হবে প্রয়োজন এবং পরিবেশের দিকে লক্ষ্য রেখে। ঘরের আকার এ ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি প্রাধান্য পাবে, ঘর ছোট হলে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন সাজানোতে হিজিবিজি ভাব চলে না আসে। সজ্জায় রাখতে হবে যথেষ্ট পরিমাণ পরিসর। বাংলাদেশে রয়েছে হাজারো প্রাকৃতিক সম্পদ। নিজস্ব এই সম্পদে ঘর সাজালে, আসবে এক নতুনত্ব। সঙ্গে প্রকৃতিকেও পাওয়া যাবে। আসবাবপত্রে দেশীয় ভাব আনার সবচেয়ে ভাল মাধ্যম হচ্ছে বেতের আসবাবপত্র। আপনার লিভিং রুমে দামী আর ভারি কাঠের সোফা ব্যবহার না করে এক সেট বেতের সোফা কিনে ফেলুন। সঙ্গে একটি সুন্দর কাচের গাসওয়ালা বেতের টি টেবিল বসিয়ে দিন। আশপাশে কয়েকটি সুন্দর বেতের টুলও বসিয়ে দিন। অথবা বারান্দার এক কোনে একটি বেতের দোলনা ঝুলিয়ে দিন। দেখুন এক নিমিষেই ঘরের চেহারা পালটে গেছে। সোফা সেট ছাড়াও আজকাল বেতের আর নানারকম ফার্নিচার পাওয়া যায়। যেমন আজকাল বাজারে ঘুরলে আপনি নানারকম বেতের খাট, ওয়্যারড্রোব, ড্রেসিং টেবিল, আলমিরা থেকে শুরু করে খাবার টেবিল চেয়ারও কিনতে পারবেন। এছাড়া এসব আসবাবপত্র আজকাল বাঁশ দিয়েও বানানো হচ্ছে। আপনি ঘরে দেশীয় আবহ আনতে এসব ফার্নিচারও কিনতে পারেন। ঘরকে সুন্দর করে সাজাতে শো পিস একটি অপরিহার্য জিনিস। আর সেই শো পিস যদি দেশজ মোটিফের হয় তবে তা একদিকে যেমন আপনার রুচির পরিচয় বহন করবে। অন্যদিকে আপনার খরচও কিছুটা বাচিয়ে দেবে। দেশীয় নানা সরঞ্জামে তৈরি এসব শোপিসগুলো একদিকে আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। অন্যদিকে ঘর সাজানোয় এনে দেয় দারুণ বৈচিত্র্যতা। আর দেশীয় পণ্য দিয়ে তৈরি শো পিসের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় আর নান্দনিক হচ্ছে মাটির শো পিস। আপনি নানাভাবে আপনার ঘরে মাটির শো পিস রাখতে পারেন। যেমন বিছানার পাশে বা পড়ার টেবিলে একটা ল্যাম্পশেড দরকার? সাধারণ ল্যাম্পশেডের বদলে মাটির ল্যাম্পশেড ব্যবহার করুন। খাবার টেবিলে ডিনার সেট হিসেবে মাটির পণ্য ব্যবহার করুন। ঘরের কোনাগুলো খালি খালি আর মলিন লাগছে? কিছু সুন্দর সুন্দর মাটির পটারি দিয়ে ঘরের কোনাগুলো সাজিয়ে ফেলুন। আপনার অযতেœ পড়ে থাকা গাছগুলোকে নতুন সুন্দর কিছু মাটির টবে বসিয়ে দিন। দেখবেন আপনার ঘর আর বারান্দার চেহারাই পালটে গেছে। এছাড়াও আপনি ঘর সাজাতে বাঁশ ও বেতের পণ্য ব্যবহার করতে পারেন। ঘরের একটা দেয়ালে বড় একটা বেতের আয়না ঝুলিয়ে দিন। ঘরটি বড় দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যতিক্রমও দেখাবে। শুধু তাই নয়। আপনি আপনার ঘরের দেয়ালের শোভা বাড়াতে বাশি, তালপাতার পাখা, মুখোশ, ঝুলানো পুতুলসহ আরও নানারকম দেশীয় পণ্য ব্যবহার করতে পারেন। ঘরে দেশীয় আসবাবপত্র আর শো-পিস তো আনলেন। এখন যদি এগুলোতে দামী বিদেশী ফেব্রিক ব্যবহার করেন তাহলে পুরো সাজটাই তো মাটি হয়ে যাবে। তাই দেশীয় আবহে ঘর সাজাতে গেলে সঠিক ফেব্রিক নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন বাংলাদেশে খুব সুন্দর সুন্দর বক, বাটিক আর এপিকের চাদর পাওয়া যায়। আপনি আপনার বাঁশ বা বেতের খাটে এসব চাদর বিছিয়ে রাখতে পারেন। আবার ঘরের পর্দা হিসেবেও দেশী ফেব্রিক আর দেশী নকশা ব্যবহার করতে পারেন। ঘরের মেঝেতে কার্পেটের বদলে উজ্জ্বল ও রঙিন শতরঞ্জি বিছাতে পারেন। আসলে দেশীয় পণ্য দিয়ে ঘর সাজানোর অপশন গুনে শেষ করা যাবে না। আপনাকে শুধু একটু কষ্ট করে খুঁজে বের করতে হবে আর মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের সুখের নীড়টাকে সাজিয়ে তুলতে হবে। বাঁশ, বেত, কাঠ, পাট, মাটি, শীতল পাটি আর জামদানির মতো উপাদানে সাজানো যেতে পারে অন্দর। বেছে নিতে হবে ছিমছাম নকশা দেখে। বাহুল্য কম থাকলে মানিয়ে যাবে ছোট-বড় অথবা মাঝারি সব রকমের ঘরেই। বাঁশ, বেত আর কাঠ দিয়ে তৈরি আসবাবে ঘর সাজালে পাওয়া যাবে প্রকৃতির পূর্ণ ছোঁয়া। দেশীয় এ উপাদানে ঘরে আসবে আধুনিকতা। চাইলে এর ওপরে বার্নিশের রঙের ক্ষেত্রে নিয়ে আসতে পারেন পরিবর্তন। দেয়ালের সৌন্দর্য বাড়াবে পোড়া মাটির টেরাকোটা। এর বিচিত্রতা আর ঐতিহ্যবাহী নকশা নিয়ে আসবে আলাদা ধরনের সৌন্দর্য। পাটের দড়ি দিয়ে করা যেতে পারে পর্দার ব্যবস্থা অথবা তৈরি করা যেতে পারে আড়াল। এতে অনন্য হবে অন্দর সজ্জা। এ ক্ষেত্রে যেহেতু সামনেই আসছে বৈশাখ, তাই বেছে নিতে পারেন উজ্জ্বল রং। পর্দা বন্ধনীতেও ব্যবহার করতে পারেন পাটের নকশা করা বন্ধনী। এর সঙ্গে কাঠের কিংবা মাটির পুঁতি বেশ লাগবে দেখতে। পর্দা অথবা দরজায় ব্যবহার করতে পারেন পাটের রশি দিয়ে তৈরি ঝালর। পর্দার ক্ষেত্রে পাতা সবুজ, আকাশ রং, ছাই অথবা ধূসর, হালকা বেগুনি, গোলাপের রং বেশ মানিয়ে যাবে এক্ষেত্রে। আর সঙ্গে মিলিয়ে রাখতে পারেন আবছা সাদা অথবা দুধ সাদা। এড়িয়ে যান রঙের গাঢ় শেডগুলো, এতে ঘর থাকবে শীতল। ফেব্রিকে বেছে নিতে হবে হালকা ধরনের ফেব্রিক। যাতে আসা-যাওয়া করতে পারে আলো-বাতাস। ঘরের এক কোনায় রেখে দিতে পারেন পটারি, রঙিন হলে বেশ লাগবে অন্দর। রাখতে পারেন মাটি অথবা ধাতব ঘণ্টা। বাতাস এসে দোলা দিয়ে গেলে মন ভরে যাবে টুং টাং শব্দে। বারান্দার কোনে রেখে দিতে পারেন সবুজ গাছের টব, দখিনা বাতাসে হাওয়া এসে দেখা দিয়ে যাবে, আসতে পারে দুয়েকটি শালিকও। বারান্দায় আরও রেখে দিতে পারেন বাঁশ, বেত অথবা কাঠের তৈরি ইজি চেয়ার। সকালে এক কাপ চা নিয়ে এখানে বসেই শুনতে পারেন পাখির গুনগুন অথবা বিকেলে চেয়ারের প্রশস্ত হাতলে বই রেখে পড়তে পারেন একটি দুটি কবিতা। আর আমাদের এই উপকরণ দিয়ে যখন সহজে সাজাতে পারি আমাদের ঘরগুলোকে। ঘরে ঢুকতেই বাড়িতে ঢোকার পথে মাটি বা টেরাকোটার সামগ্রী ব্যবহার করতে পারেন। আয়না রাখতে চাইলে মাটি, বেত বা কাঠের ফ্রেমের আয়না বেছে নিতে পারেন। পাটের শিকা ঝুলিয়ে দিতে পারেন। শখের হাঁড়ি সাজিয়ে রাখুন শিকায়। চাইলে এসব রঙিন হাঁড়ির মধ্যে প্লাস্টিকের পাত্রে মানিপ্যান্ট জাতীয় গাছও রাখতে পারেন; পরিচর্যার প্রয়োজনে প্লাস্টিকের পাত্রটি সরিয়ে নিতে পারবেন, আবার পরে রেখেও দেয়া যাবে। বৈঠকখানা- বেত, বাঁশ বা কাঠের সোফা রাখতে পারেন। সোফা না চাইলেও দুটি উঁচু চেয়ার রাখতে পারেন। সোফার মতো আরামদায়ক চেয়ারও হতে পারে এ দুটি, তবে একটু উঁচু তৈরি করা উচিত। অনেক সময় বয়স্ক ব্যক্তিদের স্বাভাবিক উচ্চতার সোফায় বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হয়। তাঁদের জন্য বাঁশ বা বেতের তৈরি এ ধরনের চেয়ারের ব্যবস্থা রাখুন। ঘরের এক পাশে বাঁশ বা বেতের নিচু ডিভান কিংবা শতরঞ্জি রাখতে পারেন শিশু আর তরুণদের গল্প-আড্ডার জন্য। সোফা আর ডিভানের কুশন কভারেও রাখুন দেশীয় নকশার ছোঁয়া। পাটের তৈরি টেবিল ম্যাচ ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া রাখতে পারেন পাটের তৈরি টিস্যু বক্স। পাটের কার্পেটও পাওয়া যাচ্ছে আজকাল। গ্রামীণ চেকের কাপড়ের পর্দা ব্যবহার করলে ভাল দেখাবে। তাঁত, জামদানি, কাতান বা সুতি কাপড়ের পর্দাও মানানসই। পেলমেট ব্যবহার না করাই ভাল। লুপ লাগানো পর্দা বেশ মানাবে। লুপের জায়গাটাতে নারিকেলের খোলের বোতাম লাগানো যায়। ল্যাম্পশেড রাখতে চাইলে সেটিও বেত, বাঁশ বা মাটির তৈরি হলে ভাল দেখাবে। ঘরে আলো আসলে এক কোনে বনসাই রাখতে পারেন। একই সঙ্গে দুটি বনসাইয়ের ব্যবস্থা রাখা ভাল; একটি বসার ঘরে, আরেকটি বারান্দা বা ছাদে রাখতে পারবেন। এক সপ্তাহ পরপর গাছ দুটি অদল-বদল করে নিন। এর ফলে দুটি গাছই পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পাবে। সাজানোর জন্য নানা ধরনের দেশীয় উপকরণে তৈরি শোপিস কিনতে পাওয়া যায়। পাট, বেত, কাঠ ও মাটির হরেক রকম শোপিস বিভিন্ন মেলায় পাওয়া যায়। আড়ং, যাত্রা বা আইডিয়া ক্রাফটসেও মিলবে এমন জিনিস। খাবার খেতে খেতে : খাবার ঘরের মাঝে পাটের তৈরি উপকরণ সুন্দর বিভাজকের কাজ করবে। শিকা জাতীয় বুননে তৈরি পাটের লম্বা স্তরে ঝিনুক লাগানো থাকলেও বেশ লাগবে। খাবার টেবিলটা কাঠের হতে পারে, আবার ওপরটায় কাচও থাকতে পারে। টেবিলের ওপর তাঁতের রানার (যেটি লম্বাভাবে খাবার টেবিলে বিছিয়ে দেয়া হয়) রাখতে পারেন। খাবার টেবিলের ওপর পাটের তৈরি নান্দনিক ঝুড়িতে দরকারি জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখা যায়। ঝুড়ির ঠিক মাঝ বরাবর সাধারণ কাচের বোতলে বালু ভরে ঝুড়ি জাতীয় ফুল রেখে দিতে পারেন। আজকাল খাবার ঘরের চেয়ারে কভার লাগানোর পুরনো রীতিটা নতুনভাবে ফিরে আসছে। এই কভারও দেশী কাপড়ে তৈরি করে নিতে পারেন। অনেক বাড়ির খাবার ঘরে মাইক্রোওয়েভ ওভেন, টোস্টার, জুসার ইত্যাদি রাখার জন্য মেঝে থেকে ফুট তিনেক উঁচু তাক থাকে। এই তাকেও দেশীয় উপকরণে তৈরি শোটি বা ফুলদানি রাখতে পারেন। থাকার রুমে : বেত বা বাঁশের সুন্দর খাট রাখতে পারেন শোয়ার ঘরে। বেডকভার হতে পারে নকশিকাঁথা। দেয়ালেও বাঁধানো নকশিকাঁথা সাজিয়ে রাখতে পারেন। মাটির পাত্রে পানিতে গোলাপের পাপড়ি বা ছোট মোমবাতি ভাসিয়ে রাখতে পারেন। মাটির বড় ফুলদানিতে রজনীগন্ধা বা দোলনচাঁপা রাখা যায়। ল্যাম্পশেডেও দেশীয় উপকরণ থাকতে পারে। এ ঘরেও তাকের পর্দা লাগালে ভাল দেখাবে। শিশুর ঘরের মেঝেতে শতরঞ্জি বিছিয়ে রাখতে পারেন। অনেক সময় শিশুরা খেলনা নিয়ে মেঝেতেই বসে পড়ে। শতরঞ্জি থাকলে ওরা এর ওপর বসে খেলতেও পারবে। দেয়ালে দেশের পতাকা, কাজী নজরুল ইসলামের ছবি রাখতে পারেন। এতে ওদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই দেশীয় সাহিত্যে আগ্রহ তৈরি হবে। ছবির ফ্রেমও দেশীয় উপকরণে তৈরি হলে ভাল। বারান্দায় ঝোলানো বেতের দোলনা রাখা যায়। এছাড়া রাখুন গাছ। গাছে ফুল ফুটলে শিশু আনন্দ পাবে। অযতেœ গাছ মারা যায়, এই বিষয়টি দুঃখের এমন বোধ ওর মধ্যে তৈরি হলে বড় হতে হতে ও যতœশীল হয়ে উঠবে। আবেগ-অনুভূতিগুলো সুস্থ পরিবেশের মাঝেই তৈরি হবে। এ ধরনের উপকরণ শিশুর মানসিক বিকাশে সহায়ক।
×