ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

কাদির খান ব্যর্থ করে দেন মোসাদ-ভারতের চেষ্টা, কে এই কাদির খান?

প্রকাশিত: ২৩:০২, ২৭ জুন ২০২৫

কাদির খান ব্যর্থ করে দেন মোসাদ-ভারতের চেষ্টা, কে এই কাদির খান?

ছবি: সংগৃহীত

ঘড়ির কাটা তখন মধ্যরাত ছুঁই ছুঁই। ১৯৯৮ সালের ২৮ মে—পাকিস্তানের ইতিহাসে এক বিস্ফোরক রাত। ইসলামাবাদের নির্জন বাতাসে ছিল চাপা উত্তেজনার গন্ধ। কাহুটা পাহাড়ঘেরা ঘাঁটিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন একজন বিজ্ঞানী—ড. আব্দুল কাদির খান। যিনি জানতেন, এই রাত শুধু তার একার নয়, পুরো জাতির ভাগ্য বদলে দেওয়ার রাত।

ড. আব্দুল কাদির খান—নামটি ইতিহাসের পাতায় যতটা গর্বের, ততটাই বিতর্কের। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক। নেদারল্যান্ডসে ইউরেনকো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবস্থায় ১৯৭৫ সালে তিনি পাকিস্তানে ফিরে আসেন, হাতে ছিল সেন্ট্রিফিউজ প্রযুক্তির নকশা, আর মস্তিষ্কে স্বপ্ন—মুসলিম বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র গড়ার।

গোপন কর্মসূচি, পশ্চিমা গোয়েন্দাদের উদ্বেগ

১৯৮০’র দশকে কাদির খানের নেতৃত্বে গোপনে এগোতে থাকে পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচি। এ নিয়ে কাঁপতে থাকে পশ্চিমা গোয়েন্দা মহল। ইসরায়েল ও ভারতের যৌথ হামলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় “অপারেশন প্যালেস্টাইন ব্লাস্ট” নামে। ভারতের জামনগর ঘাঁটি থেকে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান উড়ানোর প্রস্তুতিও চূড়ান্ত ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে সেই অপারেশন থেমে যায়।

গুপ্তচক্রের নিশানায় কাদির খান

ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদও চুপ করে বসে থাকেনি। কাদির খানের বিরুদ্ধে চালানো হয় গুপ্ত হত্যা ও অন্তর্ঘাতের একের পর এক চেষ্টা। ইউরোপে থাকা তার সংশ্লিষ্টদের ওপর হামলা হয়—জার্মান ব্যবসায়ীর বাড়িতে পাঠানো হয় বোমা, সুইস কোম্পানির নির্বাহীর গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। কিন্তু সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেন কাদির খান। অটল ছিলেন নিজের স্বপ্ন আর দেশের প্রতি দায়বদ্ধতায়।

পরমাণু শক্তিতে পাকিস্তানের উত্থান

১৯৯৮ সালের সেই বিস্ফোরণ শুধু একটি পারমাণবিক পরীক্ষা ছিল না, ছিল জাতিগত আত্মপরিচয়ের ঘোষণা। বেলুচিস্তানের চাগাই পর্বতমালায় পাকিস্তানের পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘোষিত করে দেয়—পাকিস্তান এখন বিশ্বের সপ্তম পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। কাদির খান হয়ে ওঠেন জাতীয় বীর।

ছায়া নেটওয়ার্ক ও বিতর্ক

তবে এখানেই থেমে থাকেননি কাদির খান। গড়ে তোলেন এক বৈশ্বিক ছায়া নেটওয়ার্ক। ইরান, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশকে সরবরাহ করেন পরমাণু প্রযুক্তি। এই কালোবাজারি কার্যকলাপ ফাঁস হয় ২০০৩ সালে, যখন লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফি যুক্তরাষ্ট্রকে তথ্য দিয়ে দেন। ২০০৪ সালে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে কাঁদতে কাঁদতে দোষ স্বীকার করেন কাদির খান—"আমি দেশের জন্য সব করেছি, আজ আবারও দোষ নিচ্ছি কারণ আমি আমার দেশকে রক্ষা করতে চাই।"

কে ছিলেন কাদির খান?

ড. আব্দুল কাদির খান ছিলেন একজন ধাতুবিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী, যিনি ১৯৩৬ সালে ভারতের ভোপালে জন্মগ্রহণ করেন। দেশভাগের পর পরিবারসহ পাকিস্তানে পাড়ি জমান। পরবর্তীতে জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসে পড়াশোনা ও গবেষণার মাধ্যমে নিজের মেধা ও দক্ষতার প্রমাণ দেন। ইউরেনকোতে কাজ করার সময়ই তিনি পরমাণু প্রযুক্তির গভীর জ্ঞান লাভ করেন এবং পরে সেটিকেই কাজে লাগান নিজের মাতৃভূমির জন্য।

শেষ কথা

ড. কাদির খানের গল্প শুধু একজন বিজ্ঞানীর কাহিনি নয়—এটি এক জাতির আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার গল্প। যিনি প্রমাণ করেছেন, স্বপ্ন থাকলে, জ্ঞান থাকলে আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থাকলে মোসাদের মতো শক্তিশালী শত্রুরাও থামাতে পারে না কোনো জাতিকে।

আসিফ

×