ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৬ মে ২০২৫, ১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

যুদ্ধ নয়, মস্তিষ্কের খেলা খেলছে ইরান — কাঁপছে তেলআবিব ও ওয়াশিংটন

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ২৬ মে ২০২৫

যুদ্ধ নয়, মস্তিষ্কের খেলা খেলছে ইরান — কাঁপছে তেলআবিব ও ওয়াশিংটন

ছবি: সংগৃহীত

অস্ত্রের দিক দিয়ে হয়তো এখনও পশ্চিমা শক্তিগুলোর চেয়ে পিছিয়ে তেহরান, কিন্তু এক ভিন্ন ধরনের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে ইরান—এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। বিশ্লেষকরা বলছেন, সামরিক হামলা নয় বরং এক অদৃশ্য কৌশলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে টেনে আনা হচ্ছে এমন এক যুদ্ধের ভেতরে, যেখানে নিয়ম নির্ধারক ইরান নিজেই। আর এই ‘মাইন্ড গেম’ এর শুরু ৭ অক্টোবরের হামাস হামলার পর থেকেই।

আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) জানিয়েছে, ইরানের হাতে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সমস্ত উপাদান। বিশ্লেষকদের মতে, ইরান চাইলে যে কোনও সময় এক ধাপে পৌঁছে যেতে পারে সম্পূর্ণ অস্ত্র তৈরির পর্যায়ে। অথচ, সেই মুহূর্তের কথা বলা হয়েছে বহু আগেই, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেছে কি না, সেটি এখনও নিশ্চিত নয়। বরং এমন রহস্যপূর্ণ নীরবতায় ইরান এক অদ্ভুত মানসিক চাপে ফেলে রেখেছে তার প্রতিপক্ষদের।

ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো যুদ্ধে নেই। তবু যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মতো রাষ্ট্রগুলো এখন প্রায় প্রতিদিনই ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছে ইরানের ওপর। কিন্তু ইরান সরাসরি কিছুই বলছে না, করছে না। শুধু কিছু ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা, ভিডিও প্রকাশ ও এলিট কমান্ডারদের বক্তৃতার মাধ্যমে তারা বুঝিয়ে দিচ্ছে—“আমরা প্রস্তুত আছি।”

শত্রু জানে না, সে কার সঙ্গে যুদ্ধ করছে
পশ্চিমা গোয়েন্দারা বলছেন, হামাসের ৭ অক্টোবরের আক্রমণের পেছনে ছিল ইরানের কৌশলগত পরিকল্পনা। যদিও প্রমাণ নেই, নেই কোনও প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা। অন্যদিকে লেবাননে হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহী, ইরাক ও সিরিয়াজুড়ে শিয়া মিলিশিয়ারা সক্রিয়। তারা একযোগে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। অথচ ইরান সরাসরি কোনো জায়গায় জড়িত নয় বলে দাবি করে চলেছে।

এই মুহূর্তে ইসরায়েল গাজায় ব্যস্ত, লেবাননে হিজবুল্লাহর সঙ্গে সীমান্তে ধৈর্যহীন উত্তেজনা, রেড সি'তে হুতিদের কারণে বাণিজ্যপথ বিপর্যস্ত এবং ইরাক-সিরিয়ায় মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলা। প্রতিটি আঘাতের পেছনে স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর নাম থাকলেও, ছায়ার মতো সক্রিয় রয়েছে তেহরান। বিশ্লেষকদের মতে, এটা এক ধরনের 'ছায়াযুদ্ধ', যার পুরোটাই চালানো হচ্ছে মানসিকভাবে।

মনস্তাত্ত্বিক খেলা ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি
জাতিসংঘে চীন ও রাশিয়া বারবার ইরানের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। তারা শুধু রাজনৈতিক নয়, বাণিজ্যিক সম্পর্কও শক্ত করছে তেহরানের সঙ্গে। প্রশ্ন উঠছে, ইরান কি আসলেই একা খেলছে, না কি এটি চীন-রাশিয়ার যৌথ কোনও পরোক্ষ চাল? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান একসঙ্গে বহু ফ্রন্ট খুলে শত্রুপক্ষকে মানসিকভাবে বিভ্রান্ত করছে। প্রতিক্রিয়া আসে গাজায়, কিন্তু হামলা হয় ইয়েমেন থেকে। এর ফলে ইসরায়েল একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধের চাপ নিতে গিয়ে ক্লান্ত, বিভ্রান্ত ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত।

এই ফ্রন্ট-ভিত্তিক যুদ্ধকৌশল ইসরায়েলকে ঠেলে দিয়েছে এক মানসিক জালে, যেখানে প্রতিপক্ষ স্পষ্ট নয়। অথচ প্রতিক্রিয়া দিতেও বাধ্য হচ্ছে তেলআবিব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই দোলাচলে পড়েছে। হামলার জবাব দিতে চাইলেই ছড়িয়ে পড়তে পারে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ। আর সেটাই চায় না হোয়াইট হাউস। ফলে ইরান কার্যত একটি জবাবহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

যুদ্ধ শুরু হয় না বুলেটে, শুরু হয় মস্তিষ্কে
তেহরানের ‘সাইলেন্ট স্ট্র্যাটেজি’ এখন স্পষ্ট। তারা জানে, ইসরায়েলের সব অস্ত্রের জবাব হয়তো তাদের হাতে নেই, কিন্তু মানসিক শক্তি দিয়ে যুদ্ধে জয়ের সংজ্ঞা বদলে দেওয়া যায়। আর সেটাই করছে ইরান।

বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের মূল লক্ষ্য এখনই হামলা নয়—বরং শত্রুকে ক্লান্ত করে ধ্বংস করা। অভ্যন্তরীণভাবে ইসরায়েলে যুদ্ধবিরোধী জনমত, বাজেট ঘাটতি ও সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে। এই সুযোগে ইরান পরিকল্পনা নিচ্ছে এক ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস থ্রি’র, যা হবে শুধুই সামরিক হামলা নয়—একটি মনস্তাত্ত্বিক এবং কৌশলগত ধ্বংসযজ্ঞ।


এই যুদ্ধ বুলেটের নয়, এই যুদ্ধ শুরু হয়েছে মস্তিষ্কে। এবং মস্তিষ্ক যদি হয় প্রাচীন পারস্যের, তাহলে তার কৌশল বুঝতে সময় লাগে শতাব্দী। ইরান চায় না যুদ্ধ, বরং এমন একটি অবস্থানে পৌঁছাতে চায়, যেখানে শত্রু নিজেই তার ছায়ায় পড়ে ধ্বংসের পথে হাঁটবে। এই মনস্তাত্ত্বিক ক্ষমতা দিয়েই হয়তো ইরান এখন জয় করছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বিপজ্জনক মঞ্চ।

এসএফ

×