ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৮ মে ২০২৫, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রবাসে ঈদের উৎসব বিষাদে রূপ নেয়

মোহাম্মদ সানাউল হক, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রিয়াদ, সৌদি আরব

প্রকাশিত: ১১:০০, ২৬ মে ২০২৫; আপডেট: ১১:০২, ২৬ মে ২০২৫

প্রবাসে ঈদের উৎসব বিষাদে রূপ নেয়

ছবিঃ সংগৃহীত

ভালো পরিবেশে বসবাস করা এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করার আশায় বাংলাদেশিরা প্রবাসে পাড়ি জমায়। সম্প্রতি জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ পরিসংখ্যান (বিবিএস) ব্যুরো জানিয়েছে, ‘বিদেশে অবস্থানরত’ প্রবাসীর সংখ্যা ৫০ লাখ। প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বসবাস করে, তাদের সংখ্যা প্রায় ২.১২ মিলিয়ন। বিবিএস প্রকাশিত জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ এর ন্যাশনাল রিপোর্টে এই তথ্য দেওয়া হয়।

ঈদ অর্থ আনন্দ। এর শাব্দিক অর্থ হলো ‘বারবার ফিরে আসা’ দিনটি বারবার ফিরে আসে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঈদ। এ দিনটিতে সৃষ্টিকর্তার হুকুম ফজরের সালাত আদায় করে স্ব-গোত্রীয় কবরবাসীর জন্য দোয়া করা। নতুন কাপড় পরিধান করে মিষ্টান্ন খাবার ভক্ষণ করে ময়দানে দলবেঁধে ঈদের দুই রাকাত সালাত আদায় করা, নামাজ শেষে খতিব সাহেবের ঈদুল ফিতরের খুতবা মনযোগ সহকারে শ্রবণ করা, দোয়া-দুরুদ পরবর্তীতে মহান রবের নিকট সঙ্গবদ্ধভাবে হাত তুলে মুনাজাত করা, সবশেষে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করে বাড়ি ফেরা, সবাইকে নিয়ে খোশ মেজাজে গল্প আড্ডা, ঈদ সালামি বিতরণ ইত্যাদির মাধ্যমে ঈদের আনন্দ সম্পন্ন করা। এভাবেই ঈদের ঐতিহাসিক আনন্দ একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে আসছে মুসলিম সম্প্রদায়। 

অথচ-ঈদের দিনে এই ৫০ লাখ প্রবাসীর মধ্যে সামান্য সংখ্যক ব্যতিত বাদ বাকি প্রবাসীদের ক্ষেত্রে উপরোক্ত আয়োজন হয়তোবা শুধুমাত্র স্বপ্ন!আমি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবের কথা বলছিলাম ; কেননা প্রবাসে ঈদের দিনেও বেশিরভাগ প্রবাসীর ভাগ্যে ছুটি থাকেনা! এমন ও হয় যে, অনেক প্রবাসী ঈদের নামাজটুকুও আদায় করার সুযোগ পায়না! সেক্ষেত্রে এমন প্রবাসীদের যদি প্রশ্ন করা হয় ঈদ কেমন কাটলো? এমতাবস্থায় ঐ প্রবাসীর উত্তরটা কেমন রিদয়বিদাড়ক হবে, তা আর বলার বাকি রইলো না!

সৌদি প্রবাসী মোহাম্মদ মহসিন জানান, সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে ঈদের আগের দিন তথা চাঁদ রাতে আমার নাইট ডিউটি ছিলো। যেহেতু ঈদের কয়েকদিন পূর্বেই স্থানীয় নাগরিকদের লম্বা ছুটি হয়ে যায়। তাই আজনবি তথা আমরা প্রবাসীদের ডিউটি সে-সময়ে অনেক বেশিই করা লাগে। সারারাত ডিউটি শেষ করে ভোরে বাসায় আসতে না আসতেই সুফারভাইজার আমাকে টেক্সট করলেন, ঈদের দিন সকাল ৭ টায় পুনরায় ডিউটিতে যোগ দিতে হবে। এটা মালিকপক্ষ থেকে এনশিউর করা হয়। কোন অজুহাত দেখানো যাবেনা! তাই বাধ্য হয়ে ফের প্রাইভেট গাড়ি চড়ে ডিউটিতে যোগ দিলাম। 

ঈদের আগের রাতে ডিউটিতে যাওয়ার পূর্বে দেশ থেকে আনা প্রিয় মানুষের পাঞ্জাবি পাজামাটা স্ত্রী করে রেখে এসেছি। বাসায় সেমাই-চিনি অন্যান্য খাবারের ব্যবস্থা করা আছে, সারারাত ডিউটি করে সকাল সকাল পাক-পবিত্র হয়ে প্রিয় মানুষের উপহার পাঞ্জাবিটা পড়ে অন্ততঃ ঈদের নামাজে অংশগ্রহণ করবো, নামাজ শেষে পরিচিতজনদের সাথে কোলাকুলি করে বাসায় এসে সেমাই রান্না করবো, অথচ সেই আশায় গুড়েবালি! 

কথা ছিলো আজকে ঈদের দিনে মোজ-মাস্তি, খানাপিনা, খোশগল্প করার, বলতে গেলে আমি এই খুশির দিনেও না খেয়ে রোজা! সেই সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়, এখনো বাসায় ফেরার অনুমতি আসেনা! তাছাড়া ঈদের দিনে এখানকার বেশিরভাগ খাবারের দোকানগুলো ও বন্ধ থাকে। এমন পরিস্থিতে শুধু আমি কেন, বেশিরভাগ প্রবাসীদের জন্য ঈদ একটা বিশেষ দিবস হিসেবে পরিগনিত হয়না! বলতে গেলে এই দিনটা বিষাদে রূপ নেয়!

ক্ষেত্রবিশেষে অনেক প্রবাসী আছেন, যারা বিদেশের মাটিতে বসেও দেশের ন্যায় ঈদের আনন্দ উপভোগ করেন। তবে এই সংখ্যাটা অতি নগন্য। যারা প্রবাসে ঈদকে আনন্দে রুপান্তর করতে পারেন, তাদের বেলায় দুইটা ব্যাপার কাজ করে; এক হচ্ছে তাদের কপিল/মালিক মানবিক হয়, দুই যদি তাদের আত্মীয় স্বজন প্রবাসে থাকে অথবা প্রবাসে যাদের ব্যবসা বানিজ্য রয়েছে। এই দুই শ্রেণির প্রবাসীরা ঈদকে স্বল্প আনন্দে রূপ দিতে পারেন। এছাড়া বাদবাকি বিশাল প্রবাসী জনগোষ্ঠীর কপাল মন্দ!

প্রবাসী মোহাম্মদ মহসিন বলেন ; আমিতো মোটামুটি ভালো জব করি। লাখ লাখ প্রবাসী রয়েছে, যারা ঈদের দিন ঈদের আনন্দকে প্রায়োরিটি না দিয়ে কেবলমাত্র একটা কাজের জন্য মরিয়া হয়ে আছে! এই ঐতিহাসিক খুশির দিনে সেসব প্রবাসী শ্রমিক ভাইরা যদি কেবলমাত্র একটা কাজের সন্ধান পাইতো, তাহলে সেটা হইতো তাদের জন্য ঈদের চেয়ে বেশি সুখময়। এমন সংখ্যা হাজার হাজার! ওরা একটা কাজকেই ঈদ মনে করে অপেক্ষামান।

আমার সাথে কাজ করেন এমন কয়েকজন আছেন, যার মধ্যে হাসিব ভাই এক জিবন্ত নায়ক রাজ্জাক। আজকে ৭ বছর সৌদি আরবে কাজ করেন তিনি। দেশে যাওয়ার নিদারুণ স্বপ্ন, যতবার দেশে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করছেন, বাড়ি থেকে নানান সমস্যার খবরে ফিরে আসছেন! পরিবারের দায়-দেনা কোনভাবেই উনাকে ছাড়তেছেনা! আমি উনার সাথে টানা দেড় বছর কাজ করি; সেই প্রথম দেখা জামাটা আজো উনি যত্নসহকারে পরিধান করেন। 

অথচ প্রতি ঈদে হাসিব ভাই তার পরিবারের সদস্যদের নতুন কাপড় কেনাকাটার জন্য লাখখানেক টাকা পাঠান। আমিসহ অন্যান্য সহপাঠীরা যদি বলি; ভাই আপনি এতো পরিশ্রম করে ভবঘুরের মুসাফিরি জীবন যাপন করে কার কি কল্যাণ আসবে! প্রতি উত্তরে তিনি বলতেন; তোমরা ও এই দিন দেখবা, অপেক্ষায় থাকো। সবেমাত্র বিদেশের মাটিতে পা রাখছো। আসলেই হাসিব ভাইয়ের কথাগুলো আজ বাস্তবিক অক্ষরে সত্য প্রমাণিত! আজ মনে হচ্ছে শুধু ঈদের সময়েই নয়, সব সময়ে নিজের পরিবারকে কিছু দিতে পারলেই নিজের কাছে কেমন যেনো ঈদের আনন্দের মত লাগে!

প্রবাসে আমার দেখা এমন অনেক ভাই বন্ধু আছেন, যারা প্রবাসে ঈদের দিন ছুটি পান, শুধু ঈদের দিনই নয়, ঈদ পরবর্তী প্রায় ৪/৫ দিন ধরে ছুটি কাটান। ঈদের নামাজ আদায় শেষে দলে দলে ভ্রমণে যান, খানাপিনা, মোজ-মাস্তি, আড্ডা সবকিছুই উপভোগ করেন কিন্তু একান্ত সময়ে উনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় ভাই ঈদ কেমন কাটলো? উত্তরে উনার চোখে এক বিষাদের লক্ষ্মণ দেখা যাবে! এতো আয়োজন, এতো আমোদফুর্তি করেও তিনি ঈদের পরিপূর্ণতা স্বীকার করেনা!

তার কারণ; সংখ্যা কিন্তু অনেক, বাট সংখ্যার আগে দশমিক দেওয়া! তাই এতগুলো সংখ্যায় ও খুশি নয়! আসলে প্রবাসে আপনি উট অথবা হরিণ দিয়েও যদি ঈদের আনন্দ উদ্যাপন করতে যান, সেই দশমিক ০০০০০০০ র মতই লাগবে। মা-বাবা, স্ত্রী সন্তান পরিবার বিহীন প্রবাসে সব উদ্যাপন ই দশমিক শুন্যের মত লাগে! 

প্রিয় পাঠক; গল্প কাহিনী বলছিনা! বাস্তবিকতার এক প্রতিচ্ছবি তুলে ধরছি। এইযে গত মাহে রমজান মাসে প্রবাসে এমন মায়ের সন্তান আছে, যাদেরকে দেশে থাকতে জোর করে খাবার গেলাত। অথচ এখানে এসে তারা ইফতারের জন্য রাস্তায় লাইন ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে, মসজিদের বাইরে খোলা আকাশের নিচে দেড় দুই ঘন্টা অপেক্ষা করে ইফতার করে! ইচ্ছে করলে এসব প্রবাসীরা প্রতিদিন ২০/২২ রিয়াল খরচা করে ইফতারের আয়োজন করতে পারেন। তা না করে মসজিদের ইফতারে আগ্রহ হওয়ার কারণ ঐ একটাই, টাকাটা বেচে যাবে। আর এই টাকায় সংসারে কাজে লাগালে নিজের কাছে ঈদের আনন্দ মনে হবে।

সবশেষে বাস্তবতা একটাই; প্রবাসীদের জন্য ঈদ বলতে ভোগ বিলাসিতা নয়! প্রবাসীদের ঈদ হচ্ছে বিদেশে মোটামুটি ভালো একটা জবের ব্যবস্থা, প্রবাসীদের ঈদ হচ্ছে প্রতি মাসে দেশে ভালো একটা টাকা পাঠানো, আর যখন কোন প্রবাসী শুনে তাদের পরিবার ভালো আছেন, বাবা-মা কথা কইতেছেন, ভাই-বোন পড়াশোনা করতেছেন, স্ত্রী হাসি-খুশিতে আছেন, সন্তানরা সুস্থ আছে, এসব শুনলেই প্রবাসীদের কাছে ঈদের আনন্দের মত লাগে!  আর এটাই প্রবাসীদের ঈদ। ঈদ মুবারক। 
 

নোভা

×