
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব ইতিহাসের এক অনন্য ও সমৃদ্ধ প্রাচীন সভ্যতা হলো চীন। প্রায় ৮,০০০ বছর আগে এই সভ্যতার সূচনা হয় এবং প্রায় ১,৮০০ বছর আগে হান রাজবংশের পতনের মাধ্যমে এর প্রাচীন যুগের অবসান ঘটে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, দার্শনিক চিন্তা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং সামরিক কৌশলে প্রাচীন চীন ছিল সময়ের চেয়ে এগিয়ে। তাদের নির্মিত গ্রেট ওয়াল, টেরাকোটা সৈন্যদল, কাগজ ও কম্পাসের মতো উদ্ভাবন এবং কনফুসিয়াসের মতো দার্শনিকের চিন্তাধারা আজও মানবসভ্যতাকে প্রভাবিত করছে।
প্রাচীন চীনের ভূখণ্ড বর্তমান চীনের মধ্যেই বিস্তৃত ছিল। এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ সালের দিকে এবং এটি টিকে ছিল খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত। প্রায় ৬,২০০ বছর ধরে এই সভ্যতা নানা রাজবংশের অধীনে বিকাশ লাভ করে।
চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন উপভাষা প্রচলিত থাকলেও, সবাই একই লিখনপদ্ধতি ব্যবহার করত। এই অভিন্ন লিপি ব্যবস্থাই বিভিন্ন রাজ্যকে সাংস্কৃতিকভাবে যুক্ত রেখেছিল।
প্রাচীন চীনে পাঁচটি উল্লেখযোগ্য রাজবংশ ছিল। শেষ রাজবংশ হান ডাইনেস্টি, যেটি রোমান সাম্রাজ্যের সমসাময়িক। এই রাজবংশসমূহের শাসনব্যবস্থা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক বিন্যাস প্রাচীন চীনকে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে।
১৯৭৪ সালে চীনের শানসি প্রদেশে কৃষকরা খুঁজে পান হাজার হাজার কাদামাটির তৈরি সৈন্যমূর্তি। এগুলোকে বলা হয় “টেরাকোটা আর্মি”। ধারণা করা হয়, ২১০ খ্রিস্টপূর্বে মারা যাওয়া প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াং তার পরকালের রক্ষার জন্য এগুলো কবরস্থ করেছিলেন। প্রতিটি মূর্তি ভিন্ন মুখাবয়ব, অস্ত্র ও পোশাকসহ তৈরি, যা প্রতিটি মূর্তিকে আলাদা ব্যাক্তিত্ব দেয়।
চীনের বিভিন্ন রাজ্য খ্রিস্টপূর্ব ৭৭০ থেকে ৪৮০ সালের মধ্যে নিজেদের রক্ষা করতে ছোট ছোট প্রাচীর নির্মাণ করে। কিন শি হুয়াং সম্রাট হয়ে সেগুলোকে একত্র করেন এবং শুরু হয় বিশালাকৃতির প্রাচীর নির্মাণ। পরে বিভিন্ন যুগে এটি সম্প্রসারিত হয়ে প্রায় ২০,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ হয়।
প্রায় ৩,০০০ বছর আগে চীনারা কচ্ছপের খোলস বা পশুর হাড়ে খোদাই করে লিখত, যার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জানার চেষ্টা করত। আগুনে গরম করে সৃষ্ট ফাটলের ধরন দেখে তারা সিদ্ধান্ত নিতো। এগুলোকে বলা হয় ‘অরাকল বোনস’।
হান রাজবংশের সময় চৌম্বক কম্পাসের আবিষ্কার হয়। মজার বিষয়, শুরুতে এটি দিক নির্ধারণে নয় বরং ভাগ্য গণনায় ব্যবহার হতো। একইসঙ্গে কাগজ তৈরির প্রাথমিক প্রক্রিয়াও আবিষ্কৃত হয় এই চীনেই, প্রায় ১,৯০০ বছর আগে।
প্রাচীন চীনে ড্রাগনকে বাস্তব ও ঈশ্বরসদৃশ শক্তির প্রতীক মনে করা হতো। ড্রাগনকে সৌভাগ্য, বৃষ্টি, কৃষি এবং সুরক্ষার দেবতা হিসেবে পূজা করা হতো।
কনফুসিয়াস (৫৫১–৪৭৯ খ্রিস্টপূর্ব) ছিলেন চীনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক। তিনি সমাজে শৃঙ্খলা, মানবিকতা, সততা ও জ্ঞানের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তার প্রচারিত কনফুসিয়াসবাদ কোনো ধর্ম নয়, বরং একটি জীবনদর্শন। হান সম্রাট হান উদি এটিকে রাষ্ট্রীয় মতবাদে রূপ দেন, যা আজও চীন ও পূর্ব এশিয়ায় প্রভাবশালী।
বিখ্যাত সম্রাটগণ
কিন শি হুয়াং: প্রথম চীনা সম্রাট, যিনি চীনকে একত্রিত করেন। তিনি মুদ্রা, মাপজোক এবং লিখনব্যবস্থায় এককতা আনেন।
গাওজু (লিউ ব্যাং): একজন কৃষক থেকে সম্রাট হন এবং হান রাজবংশ শুরু করেন।
হান উদি: কনফুসিয়াস মতবাদকে রাষ্ট্রীয় আদর্শে পরিণত করেন এবং সাম্রাজ্যকে আরো বিস্তৃত ও শক্তিশালী করেন।
প্রাচীন চীনের ইতিহাস এক বিস্ময়কর অভিযাত্রা। প্রযুক্তি, ধর্ম, রাজনীতি, স্থাপত্য ও দার্শনিকতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা আজও গবেষণার বিষয়। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখনও খুঁজে চলেছেন সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের চিহ্ন, যা প্রমাণ করে চীন শুধু অতীতেই নয়, ভবিষ্যতের পথনির্দেশক হিসেবেও সমুজ্জ্বল।
মুমু