
ছবি: সংগৃহীত
গাজায় যুদ্ধবিরতি আলোচনার গতি থেমে যাওয়ার মধ্যেই ইসরায়েলি বাহিনীর টানা হামলায় শনিবার (স্থানীয় সময়) কমপক্ষে ১১০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে চিকিৎসা সূত্র। নিহতদের মধ্যে ৩৪ জন মানুষ খাদ্য সহায়তা নিতে গিয়ে প্রাণ হারান দক্ষিণ রাফার একটি সহায়তা কেন্দ্রে।
রাফার আল-শাকুশ এলাকায় অবস্থিত মার্কিন-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF)-এর একটি কেন্দ্রে লাইনে দাঁড়িয়ে খাদ্য সহায়তা পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা লোকদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী গুলি চালায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। সেখানে উপস্থিত সামির শা'আত বলেন, “যে ব্যাগে খাবার পাওয়ার আশা ছিল, সেই ব্যাগেই মৃতদেহ মোড়ানো হচ্ছে। এটা কোনো সহায়তা কেন্দ্র না, এটা মৃত্যুকূপ।”
GHF কেন্দ্রের বাইরে থাকা মোহাম্মদ বারবাখ নামের এক ফিলিস্তিনি বলেন, “আমরা খাবার নিতে এসেছিলাম। আমাদের হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে ঠিক তখনই তারা আমাদের ওপর গুলি চালায়। যেন আমরা শিকার পাখি।” আল জাজিরার প্রতিবেদক তারেক আবু আজজুম বলেন, রাফায় শুধু একটি সহায়তা কেন্দ্র চালু থাকায় হাজার হাজার মানুষ সেখানে জড়ো হয়েছিলেন। কিন্তু ইসরায়েলি সেনারা কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই সরাসরি গুলি চালায়।
গাজায় চিকিৎসকদের মতে, মে মাসের শেষ দিক থেকে GHF এর কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে সেখানে ৮০০-র বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৫ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন। আল-আকসা হাসপাতালের মুখপাত্র খালিল আল-ডগ্রান জানান, “নিহতদের বেশিরভাগের মাথা ও পায়ে গুলি লেগেছে। ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর মারাত্মক ঘাটতির কারণে আমরা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছি।”
শনিবার গাজা শহরে জাফা স্ট্রিটে একটি বাসভবনে বোমা হামলায় ৪ জনসহ মোট ১৪ জন নিহত হয়েছেন। জাবালিয়ায় দুটি আবাসিক ভবনে বোমাবর্ষণে ১৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং শাতি শরণার্থী শিবিরে আরও ৭ জন নিহত হয়েছেন।
উত্তর গাজার বেইত হানুন এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনী প্রায় ৫০টি বোমা ফেলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, গত ৪৮ ঘণ্টায় তারা গাজায় ২৫০ বারের বেশি হামলা চালিয়েছে। একই সঙ্গে তারা খাদ্য ও অন্যান্য মানবিক সহায়তা গাজায় প্রবেশেও বাধা দিচ্ছে।
গাজা সরকার জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত অপুষ্টিজনিত কারণে ৬৭ জন শিশু মারা গেছে এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী ৬ লাখ ৫০ হাজার শিশু তাৎক্ষণিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গত তিন দিনে খাদ্য ও ওষুধের অভাবে আরও বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলেও তারা জানায়।
কাতারে চলমান যুদ্ধবিরতির আলোচনায় অগ্রগতি থেমে গেছে। হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে মূল বিরোধ ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের মানচিত্র নিয়ে। হামাসের মতে, ইসরায়েল যে মানচিত্র প্রস্তাব করেছে, তাতে গাজার প্রায় ৪০ শতাংশ এলাকায় তাদের দখল বজায় থাকবে, যার মধ্যে রাফাও রয়েছে।
হামাস চায় ইসরায়েল মার্চের আগের যুদ্ধবিরতির সীমায় ফিরে যাক। ইসরায়েল এই মানচিত্রে সম্মত হলে বহু বাস্তুচ্যুত মানুষকে রাফার আশেপাশে সংকীর্ণ এলাকায় ঠেলে দেওয়া হবে বলে অভিযোগ তুলেছে হামাস।
মধ্যপ্রাচ্য কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স-এর ফেলো ওমর রহমান বলেন, “২০২৩ সালের অক্টোবর থেকেই স্পষ্ট, ইসরায়েলের উদ্দেশ্য হলো গাজার সামাজিক কাঠামোকে ধ্বংস করা, জনসংখ্যাকে বলপূর্বক উচ্ছেদ করা এবং পুরো অঞ্চলটিকে জনমানবশূন্য করে তোলা।”
তিনি আরও বলেন, “GHF কেন্দ্রগুলো আসলে একটি কৌশল, যেখানে মানুষের সহানুভূতি নিয়ে তাদের একটি কেন্দ্রীভূত এলাকায় আটকে রাখা হচ্ছে, যেন ভবিষ্যতে তাদের স্থানান্তর সহজ হয়।”
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ যে ২১ লাখ ফিলিস্তিনিকে রাফার ধ্বংসস্তূপের ওপর “মানবিক শহর” বানিয়ে রাখার পরিকল্পনা দিয়েছেন, তা নিয়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
এই পরিকল্পনাকে অনেক বিশ্লেষক ও মানবাধিকার সংগঠন “নতুন রকমের জাতিগত নির্মূল” বা “জোরপূর্বক জনসংখ্যা স্থানান্তরের” পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ইসরায়েলি বিশ্লেষক আকিভা এলদার বলেন, “এই পরিকল্পনা অবৈধ এবং নৈতিকভাবে গর্হিত। যারা এতে অংশ নেবে, তারা যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকবে।”
তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লরেঞ্জো কামেল বলেন, “১৯৪৮ সালের এই দিনেই লিড্ডা থেকে ৭০ হাজার ফিলিস্তিনিকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেকেই পরে গাজায় আশ্রয় নিয়েছিল। আজকের পরিকল্পনা সেই ইতিহাসেরই এক ভয়ঙ্কর পুনরাবৃত্তি।”
তিনি বলেন, “রাফার ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন করে যে শিবির বানানোর পরিকল্পনা, তা মূলত আরও একটি বন্দিশিবির— যেখান থেকে আবারও ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দেওয়া সহজ হবে।”
সূত্র: আল জাজিরা
এম.কে.