ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১১ মে ২০২৫, ২৭ বৈশাখ ১৪৩২

“আমি কি শুধু স্বর্গেই মাংস খাব?”—এক ফিলিস্তিনি শিশুর প্রশ্নের সামনে নীরবতা

প্রকাশিত: ২২:৪৬, ১০ মে ২০২৫; আপডেট: ২২:৪৭, ১০ মে ২০২৫

“আমি কি শুধু স্বর্গেই মাংস খাব?”—এক ফিলিস্তিনি শিশুর প্রশ্নের সামনে নীরবতা

ছবি: সংগৃহীত

রমজান মাসের শুরুতে আমরা যখন শুনলাম গাজার সব ক্রসিং বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তখন ভেবেছিলাম—এই অবস্থা বড়জোর দুই সপ্তাহ থাকবে। স্বপ্ন ছিল, এবারের রমজানে অন্তত বেঁচে থাকা আত্মীয়দের ডেকে ইফতার করাবো, একটা স্বাভাবিক পারিবারিক মুহূর্ত কাটাবো। কিন্তু বাস্তবতা ছিল অনেক নির্মম। আমরা পুরো মাস কাটিয়েছি টিনজাত খাবারে ইফতার করে।

আমার পরিবার, গাজার প্রায় সব পরিবারের মতো, কোনো সঞ্চয় করেছিল না। কে জানত আবার এমন করে যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে! বাজার থেকে খাবার উধাও হয়ে গেল, দাম যেন উড়তে লাগল আকাশে। এক কেজি সবজি ৮ ডলার, চিনি ২২ ডলার, শিশুখাদ্য ১১ ডলার। আটার বস্তা ৮ ডলার থেকে ৫০, আর মাত্র দুই মাসে ৩০০ ডলার পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

এমন দামে সাধারণ মানুষের পক্ষে খাওয়া সম্ভব না। সকালের নাশতা আর রাতের খাবারে সীমাবদ্ধ আমরা, তাও মাত্র অর্ধেক রুটি বা এক রুটিতে। গাজার মানুষ এক প্লেট খাবার বা কয়েকটা রুটির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে—শরীরের দুর্বলতা আর মনে অপমান নিয়ে।

নুসাইরাত আর দেইর আল-বালাহের তিনটি বেকারিতে পুরো মধ্য গাজার ভরসা ছিল। ভোর থেকে আমার বাবা লাইনে দাঁড়াতেন। পরে আমার ভাই তার জায়গা নিত। কখনো-সখনো তারা দিন শেষে খালি হাতে বাড়ি ফিরতেন। মার্চের শেষে যখন জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানাল যে বেকারিগুলো চালানোর মতো আর আটা বা গ্যাস নেই, তখনই বুঝি—এবার সত্যিকারের দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছে।

দানাশীল রান্নাঘরগুলোও ধীরে ধীরে বন্ধ হতে শুরু করে। কয়েকদিন আগেই আমরা শুনলাম, আমাদের এলাকায় থাকা রান্নাঘরটি টিকে আছে—যেন একরকম সৌভাগ্য।

আমার আট বছর বয়সী ভাতিজি দানা প্রতিদিন সেখানে লাইনে দাঁড়ায়, যেন কোনো খেলা। এক চামচ খাবার পেয়েও সে খুব গর্বিত হয়ে বাড়ি ফেরে। না পেলে কাঁদতে কাঁদতে ফেরে—জগতকে অন্যায্য মনে হয় তার।

রমজানের একদিন, আমাদের বাড়ির পাশে আল-মুফতি স্কুলে আশ্রয় নেওয়া একটি শিশু খাবারের জন্য দৌড়াতে গিয়ে রান্না করা গরম হাড়িতে পড়ে যায়। তার শরীর পুড়ে যায়। পরে সে মারা যায়।

আমার ১৮ মাস বয়সী মুসাব আর ২ বছরের মোহাম্মদ প্রায় পুরো রমজানটাই জ্বরে ভুগেছে। খাবার, ওষুধ—সবকিছুর অভাবে তারা সুস্থ হতে পারে না। আমার মা চোখের অপারেশনের পর প্রয়োজনীয় ওষুধ না পাওয়ায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলছেন ধীরে ধীরে।

আমি নিজেও অসুস্থ। যুদ্ধের আগে রক্তদান করেছিলাম। এখন আমি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছি যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। ওজন কমেছে, মাথা ঘোরে। ডাক্তারের পরামর্শ—ফল খাও, মাংস খাও। কিন্তু তিনি নিজেও জানেন, এটা সম্ভব না।

সবচেয়ে কষ্টকর দিক—এই দুর্ভিক্ষ ছোট শিশুদের বোঝানো। তারা বিশ্বাস করে, আমরা ইচ্ছে করে তাদের মাংস বা ফল দিচ্ছি না। অথচ বাস্তবতা হল—আমাদের হাতেই কিছু নেই।

আমার পাঁচ বছর বয়সী ভাতিজা খালেদ প্রতিদিন মাংস চায়। মায়ের ফোনে খাবারের ছবি দেখে সে জিজ্ঞাসা করে, “বাবা (যিনি শহিদ হয়েছেন) কি স্বর্গে এসব খেতে পান?” তারপর আবার জিজ্ঞেস করে, “আমার কখন যাবে পালা, বাবা’র সাথে খেতে?”

আমরা চুপ থাকি। তাকে ধৈর্য ধরতে বলি, স্বর্গের প্রতিশ্রুতি দিই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমরা নিজেরাই জানি—এ কোন পৃথিবী, যেখানে শিশুদের প্রশ্নের জবাব দিতে হয় চোখের পানি গিলে?

আমি অসহায় বোধ করি। প্রতিদিন ক্ষুধায় কাঁপতে থাকা শরীর, রুগ্ন শিশুদের দেখে মনে হয়, এই বিশ্ব কি চোখ বন্ধ করে বসে আছে? একটুকরো রুটি দেওয়ার সামর্থ্যও কি নেই তাদের?

দখলদার বাহিনী আমাদের হত্যা করছে—বোমা, ক্ষুধা, রোগ; যেভাবেই হোক। আমরা রুটি ভিক্ষা করছি, অথচ বিশ্ব তাকিয়ে রয়েছে নির্বিকারভাবে।

এসএফ

আলজাজিরাতে লিখেছেনঃ হালা আল-খাতিব, গাজা থেকে।

×