
যুক্তরাষ্ট্র নেটোর পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি অনুসরণ করবে কি না, সেই প্রশ্নে আবারও সংশয় তৈরি করলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। নেটো সম্মেলনে যোগ দিতে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে রওনা হওয়ার পথে ট্রাম্প মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, “নেটোর ধারা ৫-এর বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে, আপনি জানেনই তো। তবে আমি বন্ধু থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
পরবর্তীতে এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি জীবন বাঁচাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।” তবে এ নিয়ে বিস্তারিত elaboration না দিয়ে বলেন, “বিমানে থাকা অবস্থায় আমি এসব বিষয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না।”
ট্রাম্পের এই মন্তব্যকে ঘিরে নেটো সম্মেলন ঘনিয়ে ওঠার আগেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, নেটোর প্রতি তার আগের বিরূপ মনোভাবের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে এবারও।
ট্রাম্প যখন দ্য হেগে নেটো সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছেন, তখন মধ্যপ্রাচ্যে টান টান উত্তেজনা। ইরানের তিনটি পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র লক্ষ্য করে মার্কিন বিমান হামলা চালানো হয়েছে এবং এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ইসরায়েল ও ইরান পুরোপুরি যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছেছে। যদিও ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই তিনি বলেন, উভয় পক্ষই যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করেছে।
নেটো মহাসচিব মার্ক রুটে এই ইস্যু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও রোববার দ্য হেগের রাস্তায় শত শত মানুষ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশ নেয়, যেখানে মূল প্রতিবাদ ছিল প্রতিরক্ষা খরচ নিয়ে।
২০১৭ সালের নেটো সম্মেলনে ট্রাম্পের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে মন্টেনেগ্রোর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দিয়ে নিজে সামনে চলে যাওয়ার ঘটনায়। এরপর ২০১৮ সালে তিনি প্রশ্ন তোলেন নেটোর কার্যকারিতা নিয়ে এবং সদস্য দেশগুলোকে পর্যাপ্ত খরচ না করার অভিযোগ তোলেন।
ব্রাসেলসে সেই বছরের সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, প্রতিটি দেশকে তাদের জিডিপির ৪ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে হবে। এবার তিনি বলেছেন, “৫ শতাংশ হলে আরও ভালো।”
ট্রাম্প দাবি করেন, “নেটো তখন প্রায় ধ্বংসের মুখে ছিল। আমি বলেছিলাম, তোমাদের খরচ বাড়াতে হবে। এখন তারা অনেক বেশি দিচ্ছে।”
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্ক কমিটির শীর্ষ ডেমোক্র্যাট সদস্য জিন শাহিন বলেছেন, ট্রাম্প যদি নেটোর মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেন, তাহলে সেটি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের জন্য এক প্রকার বিজয় হবে।
“এটা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো উপকারে আসবে না। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তাও এতে বিপন্ন হবে,” বলেন শাহিন।
২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণাতেই ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, নেটো চুক্তির ধারা ৫ অনুসরণ তার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। এমনকি ২০২৪ সালের এক প্রচারসভায় তিনি দাবি করেন, কোনো দেশ যদি প্রতিরক্ষা খরচ না বাড়ায়, তবে তিনি রাশিয়াকে “যা ইচ্ছে তাই করতে উৎসাহিত করবেন।”
এবার দ্য হেগ সম্মেলনে ট্রাম্প ৫ শতাংশ খরচ বৃদ্ধির দাবি তোলেন, যা অন্যান্য দেশকে নজিরবিহীন বিনিয়োগে বাধ্য করবে। নেটো মহাসচিব রুটে এক গোপন বার্তায় ট্রাম্পকে প্রশংসা করে লিখেছেন, “আপনি এমন কিছু অর্জন করতে যাচ্ছেন যা গত কয়েক দশকে কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্ট পারেননি।”
ট্রাম্প যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব খরচ ৫ শতাংশে তোলার বিষয়টি নিয়ে নমনীয়তা দেখিয়েছেন, তবু বিতর্ক রয়ে গেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা খরচ জিডিপির প্রায় ৩.৪ শতাংশ।
অন্যদিকে, অধিকাংশ নেটো দেশ এখন রাশিয়ার আগ্রাসন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে ৫ শতাংশের লক্ষ্য পূরণে প্রস্তুত হচ্ছে।
আটলান্টিক কাউন্সিলের স্ট্র্যাটেজি ও সিকিউরিটি বিভাগের প্রধান ম্যাথিউ ক্রোনিগ বলেন, “ট্রাম্প সরাসরি না বললেও ইউরোপে এখনো ভয় রয়ে গেছে, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো নেটো ছাড়বে বা ধারা ৫ মানবে না। তাই ট্রাম্পকে খুশি রাখার জন্যই ইউরোপের দেশগুলো এখন মরিয়া।”
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও নেটোতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ম্যাট হুইটেকার আশ্বস্ত করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এখনো নেটোর প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ এবং এটিকে আরও শক্তিশালী করাই তাদের লক্ষ্য।
হোয়াইট হাউস এখনও নিশ্চিত করেনি ট্রাম্প দ্য হেগে কাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। তবে তিনি জানিয়েছেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে হয়তো সাক্ষাৎ হবে। মঙ্গলবার রাতে তিনি অবস্থান করবেন ডাচ রাজা উইলেম-আলেক্সান্ডারের বাসভবন হুইস টেন বস্ক প্রাসাদে।
সূত্র:এপি
আফরোজা