
ছবি: সংগৃহীত
ক্যালিফোর্নিয়ার হীন রেডউড বনের গভীরে প্রতিবছর একবার জমে ওঠে এক অভিজাত, গোপন ক্যাম্প। নাম তার বোহেমিয়ান গ্রোভ, যেখানে এক সপ্তাহব্যাপী চলতে থাকে বিচিত্র সব আচার-অনুষ্ঠান, পারফরম্যান্স, ও গোপন বৈঠক। এই ক্যাম্পের আয়োজক বোহেমিয়ান ক্লাব, যার সদস্য তালিকায় আছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, রাজনীতিক, অভিনেতা, লেখক ও মিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ীরা।
অনেকে বলেন, এই ক্লাব নিছক অবসর কাটানোর জায়গা নয়, বরং এখান থেকেই গোপনে নেওয়া হয় ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বড় বড় সিদ্ধান্ত।
১৮৭২ সালে সানফ্রান্সিস্কোর সাংবাদিক, লেখক, অভিনেতা ও আইনজীবীদের উদ্যোগে গঠিত হয় এই ক্লাব। এরপর ১৮৭৮ সালে তারা প্রথমবারের মতো ক্যাম্পের আয়োজন করে। শুরুতে এলাকা ভাড়া নেওয়া হলেও পরে তারা পুরো জায়গাটি কিনে নেয়।
এই ক্লাব নিয়ে বিতর্কের বড় অংশ জুড়ে আছে তাদের আচার ও গোপনীয়তা। অনেকেই মনে করেন, বোহেমিয়ান ক্লাবের রীতি-নীতি প্রাচীন ড্রইড সংস্কৃতির অনুসরণে গড়া। ড্রইডরা বিশ্বাস করত যে প্যাঁচা হচ্ছে মলেকের প্রতীক, যাকে আবার নমরুদের এক রূপ হিসেবে ধরা হয়। মলেকের উদ্দেশ্যে অতীতে সন্তান বলি দেওয়ার ইতিহাসও আছে।
বোহেমিয়ান গ্রোভে রয়েছে একটি বিশাল কংক্রিটের প্যাঁচার মূর্তি, যার সামনে কুস্পুতুলিকা দাহ করে এক বিশেষ অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এই আচার ঘিরেই সবচেয়ে বেশি বিতর্ক। অনেকে তো বলেন, সেখানে জীবন্ত মানুষও বলি দেওয়া হয়—যদিও এর প্রমাণ মেলেনি।
গ্রোভের ভিতরে রয়েছে “গ্রোভ স্টেজ”, যার সামনে প্রায় ২০০০ জনের বসার ব্যবস্থা। এখানে সপ্তাহজুড়ে চলে গান, নাচ, নাটক, অর্কেস্ট্রা ও নানা পরিবেশনা। নারী সদস্যদের প্রবেশাধিকার এই ক্লাবে প্রায় নেই বললেই চলে। প্রতিষ্ঠার সময় চারজন নারী সদস্য থাকলেও, তাদের জন্য ছিল নানা সীমাবদ্ধতা। বিশেষ করে রাতের অনুষ্ঠানগুলোতে তারা উপস্থিত থাকতে পারতেন না।
এই ক্লাবের মূলমন্ত্র "Weaving spiders come not here", অর্থাৎ, এখানে পার্থিব বা ব্যবসায়িক আলোচনা নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটে? তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন ও সন্দেহ।
বিশেষভাবে আলোচিত একটি বিষয় হলো, ম্যানহাটন প্রজেক্ট—যার মাধ্যমে তৈরি হয় পারমাণবিক বোমা—নাকি প্রথম গঠিত হয় এই ক্লাবের আলোচনায়! ১৯৪২ সালে রবার্ট ওপেনহেইমার ও এনরিকো ফার্মির মতো বিজ্ঞানীরা বোহেমিয়ান গ্রোভে উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি রয়েছে, যা এই ক্লাবের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ আরও বাড়ায়।
ক্লাবটি ঘিরে রয়েছে দুর্ভেদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রয়েছে ভাড়াটে সেনার প্রহরা, মোশন ডিটেক্টর, নাইট ভিশন ক্যামেরা, ভাইব্রেশন সেন্সর, এমনকি গোপন উপস্থিতির আভাস পেলেই সেখানে পৌঁছে যায় যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা বা সেনাবাহিনী।
এই কঠোর নিরাপত্তার কারণে বহু মানুষ কৌতুহলবশত ক্লাবের কার্যক্রম গোপনে ক্যামেরায় ধারণের চেষ্টা করেছেন।
১৯৮০ সালে রিক লোগার নামে এক ব্যক্তি কর্মীর ছদ্মবেশে সেখানে দুই সপ্তাহ অবস্থান করেন।
১৯৮৯ সালে স্পাই ম্যাগাজিনের সাংবাদিক ফিলিপ ওয়েস এক সপ্তাহ ক্লাবে থাকলেও পরে ধরা পড়েন এবং গ্রেফতার হন। তিনি এরপর লেখেন বই—"Inside the Bohemian Grove"।
২০০০ সালে আলোচিত মার্কিন টক শো হোস্ট অ্যালেক্স জোন্স ও তার ক্যামেরাম্যান গোপনে গ্রোভের ভিডিও ফুটেজ ধারণ করেন।
প্রশ্ন জাগে—এই ক্লাবের সদস্য হওয়া কি সবার পক্ষে সম্ভব? উত্তর হলো, না। আপনি যদি ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী কেউ না হন, তাহলে আপনাকে ২৫ হাজার মার্কিন ডলার দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হবে। গুজব আছে, কেউ যদি ৩০ বছর বয়সে রেজিস্ট্রেশন করে, তবে হয়তো সে জীবদ্দশায় সদস্য হতে পারবে—এই ক্লাবের অপেক্ষমাণ তালিকা এতটাই দীর্ঘ।
বোহেমিয়ান ক্লাবের রহস্যময়তা, গোপন আচারের ইতিহাস, এবং বিশ্ব রাজনীতির সম্ভাব্য প্রভাব এরকম একটি প্রতিষ্ঠানকে বৈশ্বিক ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছে জনমনে। যদিও প্রমাণ এখনো অস্পষ্ট, তবু প্রশ্ন থেকেই যায়—বোহেমিয়ান গ্রোভ কি কেবল এক সপ্তাহের অভিজাত বিনোদন, নাকি বিশ্বের ভবিষ্যত বদলে দেওয়ার আসর?
এসএফ