
ছবি: প্রতীকী
আমরা প্রতিদিন জীবনে নানা রকম অনুভূতির মুখোমুখি হই। কখনো আনন্দ, কখনো দুঃখ, কখনো রাগ, কখনো হতাশা—এই সব অনুভূতিই আমাদের জীবনের অংশ। তবে অনেক মানুষ আছেন যারা নিজেদের কষ্ট, দুঃখ কিংবা ক্ষোভ প্রকাশ না করে মনে চেপে রাখেন। সমাজ, পরিবার, কাজ বা সম্পর্কের কারণে অনেকে মনে করেন এসব অনুভূতি প্রকাশ করা দুর্বলতার লক্ষণ। তাই তাঁরা চুপ থাকেন, মুখে হাসি রাখেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে চাপা ক্ষোভে জ্বলে-পুড়ে যান। এই চেপে রাখা আবেগ ধীরে ধীরে শরীরে নানা ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে হৃদযন্ত্রের (হার্ট) ওপর এর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে।
চিকিৎসা ও মনোবিজ্ঞান গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষ দীর্ঘদিন ধরে তাদের আবেগ, কষ্ট বা রাগ প্রকাশ না করে মনেই জমিয়ে রাখেন, তাঁদের হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেশি। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যখন কেউ রাগ, দুঃখ বা হতাশা মনে চেপে রাখে, তখন শরীরে কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন নামের স্ট্রেস হরমোন বাড়তে থাকে। এই হরমোনগুলো হৃদযন্ত্রের রক্তনালী সংকুচিত করে, রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং হার্টের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতাকে ব্যাহত করে। ফলে হার্টে চাপ পড়ে এবং একসময় তা মারাত্মক রূপ নিতে পারে।
অনেকেই ভাবেন, কষ্ট বা রাগ প্রকাশ করলে সমাজ বা পরিবারে তাঁরা খারাপভাবে বিবেচিত হবেন। বিশেষ করে আমাদের সমাজে পুরুষদের শেখানো হয়—“পুরুষ মানেই শক্ত, কাঁদে না, দুর্বল হয় না।” এই ধরনের ভ্রান্ত ধারনা অনেক পুরুষকে মনের দুঃখ গোপন রাখতে বাধ্য করে। কিন্তু এর মূল্য তাঁরা দিতে হয়ত দেন শরীরের ভেতরে—একটি নীরব হৃদরোগের মাধ্যমে।
একটি চেপে রাখা ক্ষোভ বা দীর্ঘদিনের কষ্ট কখন যে ভয়ংকর স্ট্রেসে রূপ নেয়, তা অনেকেই বুঝতে পারেন না। দেখা যায়, অফিসের চাপ, সংসারের সমস্যা, আর্থিক অনিশ্চয়তা, দাম্পত্য কলহ—এসব নিয়ে দীর্ঘদিন মন খারাপ থেকে যায়। কেউ কাউকে বলেন না, শুধু মনে জমে থাকে। অথচ মন যেমন একটি পাত্র, সেটারও একটা ধারণক্ষমতা আছে। যখন এই পাত্র পূর্ণ হয়ে যায়, তখন তা শরীরের ওপর চাপ ফেলে।
অনেকসময় এমনও দেখা যায়, কোনো নির্দিষ্ট একটা ঘটনা হয়ত খুব কষ্ট দিয়েছে কাউকে, কিন্তু তিনি সেটা কাউকে বলেননি। বাইরে স্বাভাবিক, কিন্তু ভেতরে তীব্র যন্ত্রণা কাজ করে। এই অভ্যন্তরীণ চাপ ধীরে ধীরে মানসিক অবসাদে পরিণত হয়, যা অবচেতনভাবে শরীরকে দুর্বল করে ফেলে। হার্ট যেহেতু আবেগ ও স্নায়ুর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, তাই এতে রক্তচাপ বেড়ে যায়, অনিয়মিত হার্টবিট শুরু হয়, বুক ধড়ফড় করে, শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এসবই হার্ট অ্যাটাকের পূর্বাভাস হতে পারে।
চিকিৎসকেরা বলেন, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা ও আবেগ প্রকাশ করাটাও এক ধরনের চিকিৎসা। কেউ কষ্ট দিলে তা নির্ভরযোগ্য মানুষকে বলা, কাউন্সেলরের সঙ্গে কথা বলা বা ডায়েরিতে লেখা—এসব উপায় মানসিক ভার লাঘবে সহায়ক। যখন মনের বোঝা হালকা হয়, তখন শরীরও ভালো থাকে।
আবার, ক্ষোভ বা রাগকে চেপে না রেখে তা স্বাস্থ্যকর উপায়ে প্রকাশ করাও জরুরি। রাগ হলে কেউ হাঁটতে পারেন, গান শুনতে পারেন, চিৎকার না করে মুখে বলে দিতে পারেন কেমন লাগছে। এসব উপায়ে আবেগের চাপ কমে, হার্টেও চাপ পড়ে না।
সুতরাং, অতিরিক্ত দুঃখ, রাগ বা ক্ষোভ যদি আপনি নিজের মধ্যে আটকে রাখেন, তাহলে সেটা শুধু মনের নয়, শরীরেরও শত্রু হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে হৃদযন্ত্রের জন্য এটা এক ধরনের নীরব ঘাতক। আজ যে ক্ষোভ আপনি চেপে রাখলেন, কাল সেটা হার্ট অ্যাটাক হয়ে ফিরে আসতে পারে। তাই নিজেকে ভালো রাখতে হলে, আবেগকে চাপা না দিয়ে প্রকাশ করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। আবেগ মানেই দুর্বলতা নয়—এটা সুস্থভাবে বেঁচে থাকারই এক গুরুত্বপূর্ণ উপায়। মনে রাখবেন, মনের বোঝা হালকা করলে, হৃদয়ের বোঝাও কমে।
এম.কে.