
সবার কমবেশি ঠাণ্ডা লাগে। হঠাৎ শীত শীত লাগে। ঠাণ্ডা লাগার অনেক কারণ আছে। ঠাণ্ডা লাগছে কেন, এর উত্তর আমরা প্রথম খুঁজি আবহাওয়াতে। কিন্তু দেখা গেল ঠাণ্ডা গরম দুই আবহাওয়াতে একটুতেই ঠাণ্ডা লাগছে, শরীর কাঁপছে, নিশ্চয়ই তার কারণ আছে।
আমাদের শরীরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশ এই কাজ করে। শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮.৬ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা ৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। তবে এটি গড় তাপমাত্রা। এর কমবেশি হতে পারে, যা স্বাভাবিক। কারও ক্ষেত্রে ৯৭ নরমাল, কারও ক্ষেত্রে ৯৯ ও নরমাল। দিনের বেলা আমাদের শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, রাত হলে কমে আসে! শরীরের থার্মোমিটার হলো হাইপোথ্যালামাস। সব সময় সে চেক করে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ল নাকি কমল। এই কাজ করে স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে তুলনা করে। তাপমাত্রা কমে গেলে বাড়িয়ে দেয়, বেড়ে গেলে কমিয়ে দেয়। শরীরের স্ট্যান্ডার্ড এই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ জরুরী তার ইন্টারনাল কাজের জন্য। বেশি তাপমাত্রা হলে এই কাজ কমে যায়, আবার বেশি কমে গেলেও কাজে ব্যাঘাত ঘটে। দুটোর সামঞ্জস্য নিয়ন্ত্রণকে বলে থার্মো রেগুলেশন। শরীরের তাপমাত্রা ৯৫ ডিগ্রী ফারেনহাইটের চেয়ে কমে গেলে তাকে বলে হাইপোথার্মিয়া, আবার শরীরের তাপমাত্রা ১০৭ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত গেলে তাকে বলে হাইপারথার্মিয়া। দুই ক্ষেত্রেই ভয়ঙ্কর। হাইপোথার্মিয়া বা কমে গেলে কার্ডিয়াক এরেস্ট, হার্ট ফেইলিউর, ব্রেইন ডেমেজ হতে পারে। হাইপার বা বেশি বেড়ে গেলে মস্তিষ্ক অকেজো থেকে মৃত্যু হতে পারে।
থার্মো রেগুলেশনের ব্যাপারটি শরীরে চারটি মাধ্যমে ঘটে! ঘাম, রক্তনালী, হরমোন এবং মস্তিষ্ক।
সবার এমন হয় না, কারও কারও হয়। সবাই একইভাবে এমন ঠাণ্ডা অনুভব করে না, কারও কারও কিছু পরিস্থিতিতে, কিছু শারীরিক সমস্যায় অল্পতেই ঠাণ্ডা লাগে। যাদের এমন সহজে ঠাণ্ডা লাগে, বাহিরের তাপমাত্রা ঘামঝরা গ্রীষ্মের খর দুপুর হোক, বসন্তের বিকেল হোক, তারা কাঁপেন, শরীরে অনেক কাপড় জড়ান, অল্পতেই শীতে জড়িয়ে যান। কেন এমন হয়! প্রথম কারণ জেনেটিক্স। আমাদের একেকজনের শরীরের গঠন একেক রকম। একেকজনের শরীরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং অনুভব একেক রকম। ব্যক্তিগত এই পার্থক্য শরীরের কাপড়েও পার্থক্য দেয়! একজন যেটায় গরম অনুভব করে, আরেকজনের জন্য সেটা পাতলা হয়ে যায়।
দ্বিতীয় কারণ পরিবেশের সঙ্গে আমাদের শরীরের সম্পর্ক। এটিও পার্সোনাল, ইউনিক এবং পার্থক্য কাজ করে।
তৃতীয় কারণ শরীরের সাইজ। আপনার শরীরের অনুপাত ঠিক করে আপনি আবহাওয়া কেমন ফিল করবেন। বিশাল শরীরে অধিক পরিমাণ তাপ উৎপাদন হয়, ফলে ছোট-খাটো যারা, তাদের শরীরে তাপমাত্রার উৎপাদন কমের কারণে ঠাণ্ডা লাগতে পারে। তাই দেখা যায় মেয়েদের শরীরের গঠন ছেলেদের চেয়ে খাটো বলে মেয়েদের তুলনামূলক শীত লাগে বেশি। এই কারণে সমান ওয়েদারে একটি ছেলে যখন ফিনফিনে শার্ট পরে ঘুরছে, তখন আরেকটি মেয়েকে কয়েক লেয়ারের কাপড় পরতে হয়।
চতুর্থ কারণ আপনার দৈনন্দিন জীবন। আপনি যতবেশি এ্যাকটিভ জীবনযাপন করবেন, ততবেশি হিট উৎপাদন হবে, ঠাণ্ডা কম লাগবে। আপনার পেশিগুলো যতবেশি কাজ করবে ততবেশি বার্ন আউট হবে।
পঞ্চম কারণ ইন্স্যুলেশন। শরীরে চর্বির পরিমাণ বেশি হলে সেটি শরীরকে ইন্স্যুলেট করে, আবৃত্ত করে রাখে, শরীরের তাপমাত্রা ক্ষয় কম হয়। এই জন্য দেখা গেছে ওয়েট লস করলে শরীরের এই ফ্যাট কমে যায় বলে ইন্স্যুলেশনের অভাবের কারণে একটু বেশি ঠাণ্ডা লাগতে পারে আগের চেয়ে। এমনকি অনেক সময় ব্যায়াম করার পর ঠাণ্ডা অনুভূত হয় বেশি।
ষষ্ঠ কারণ বয়স। বয়স বাড়লে শরীরে মেটাবোলিজম কমে যায়, তাতে ঠাণ্ডা লাগে বেশি।
সপ্তম কারণ জেন্ডার। মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় শীত অনুভব করে বেশি। ছেলেদের তুলনায় এই কারণে মেয়েদের কাপড় পরতে হয় বেশি। মেয়েদের এমন শীত অনুভব করার কারণ হরমোন। মেয়েদের পিরিয়ড সাইকেলের একেক সময় একেক হরমোনের একেক পরিমাণ থাকে, যা শরীরের বিভিন্ন কাজের সঙ্গে টেম্পারেচার রেগুলেশন থেকে টেম্পারেচার সেনসেশন পরিবর্তন আনে। ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের ইফেক্ট শরীরে চাদর জড়াতে বাধ্য করে।
অষ্টম কারণ দিনের বিভিন্ন সময়টি। সকালের তাপমাত্রার সঙ্গে নিশ্চয়ই বিকেলের তাপমাত্রার মিল নেই। একদিকে হরমোন এবং দৈনন্দিন কাজ ভেতরের তাপমাত্রার আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে, আবার বাহিরে আরেকটি আবহাওয়া। দুটোর পার্থক্য টেম্পারেচার সেনসেশনেও পার্থক্য তৈরি করে।
নবম কারণ ত্বক। মেয়েদের শরীরের ত্বক মসৃণ এবং পাতলা। এ কারণে ত্বকের কাছাকাছি থাকা রক্তনালীগুলো খুব সহজে তাপমাত্রা বের করে দিতে পারে শরীর থেকে। আর তাতে মেয়েরা সহজে তাদের হাত পায়ের আঙ্গুলগুলোতে ঠাণ্ডা অনুভব করে বেশি।
দশম কারণ কিছু কিছু রোগ এবং দরকারি উপাদানের অভাব। যেমন থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে, বিশেষ করে হাইপো থাইরয়েড হলে অল্পতেই ঠাণ্ডা লাগে। শরীরে আয়রনের অভাব দেখা দিলে একদিকে যেমন দুর্বল লাগে, সহজে ক্লান্তি আসে, একইসঙ্গে রক্ত সরবরাহে সমস্যা হয় বলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ব্যাঘাত ঘটে এবং ঠাণ্ডা লাগে। ভিটামিন ই১২-এর অভাবে এমন ঠাণ্ডা লাগতে পারে বেশি মাত্রায় এবং ঘন ঘন। রেইনডস সিনড্রোম বলে একটি সমস্যা হাত পা খুব অল্পতে ঠাণ্ডা হয়ে যায়, কখনও নীল রং ধারণ করে হাত এবং পায়ের আঙ্গুলগুলো।
বেশি পরিমাণ ঠাণ্ডার অনুভব সবসময় হতে থাকলে চুল পড়ে বেশি, শরীরের খাওয়া দেয়ার পরিপাকে গোলযোগ লেগে থাকে, ওজন বেড়ে যায়, একটুতেই মাথা ধরে!
শারীরিকভাবে একটু বেশি ঠাণ্ডা লাগা মেয়েদের বেশি হয়, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এটি যদি ঘন ঘন কোন কারণ ছাড়া, সব পরিস্থিতিতে এমন হয়, চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
ডাঃ অপূর্ব চৌধুরী
ড়ঢ়ঁৎনড়.পযড়ফিযঁৎু@মসধরষ.পড়স
কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক
লন্ডন, ইংল্যান্ড