পৃথক পাত্রে রাখা বর্জ্য
* লাল, হলুদ ও সবুজ রঙের পৃথক পাত্রে রাখা বর্জ্য
নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন এবং দূষণমুক্ত রাখার জন্য প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনা ও রিসাইকেলের (পুনর্ব্যবহার) জন্য ওয়ার্ডভিত্তিক মডেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এজন্য বর্জ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় তিন পদ্ধতি ব্যবহার করছে সংস্থাটি। এর মধ্যে বাসা-বাড়িতের পচনশীল বর্জ্য সবুজ রঙের পাত্রে, অপচনশীল (প্লাস্টিক ও পলিথিন) বর্জ্য হলুদ রঙের পাত্রে ও ঝুঁকিপূর্ণ কঠিন বর্জ্য লাল রঙের পৃথক পাত্রে সংগ্রহ করা হচ্ছে।
চসিকের ৪১টি ওয়ার্ডে এই প্রক্রিয়ায় বর্জ্য সংগ্রহের জন্য ২৮০০ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী (সেবক)’কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বর্জ্য সংগ্রহকারীদের প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য সংগ্রহে অনুপ্রাণিত করা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ২০০ জন ভাঙ্গাড়ি দোকানদারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে (চসিক) স্থানীয়ভাবে সহায়তা করছে ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা) ও অর্থিকভাবে সহযোগীতা করছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড।
চসিক সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এটি ৪১টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এবং আয়তন প্রায় ১৫৫ দশমিক ৪ বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে এই শহরে প্রায় ৫ দশমিক ২ মিলিয়ন লোক বাস করছে। চট্টগ্রাম নগরীতে প্রতিদিন গড়ে তিনহাজার টন কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়।
এর মধ্যে সিটি করপোরেশন ৭৫ শতাংশ বর্জ্য সংগ্রহ করতে পারে বাকি ২৫ শতাংশ বর্জ্য অসংগৃহীত থেকে যায়। এই ধরনের অসংগৃহীত বর্জ্য শহরের পরিবেশের ওপর বিশাল প্রভাব ফেলে। যেমন পানি নিষ্কাশনে বাধা সৃষ্টি যার কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রাম শহরের উৎপাদিত বর্জ্যরে একটি বড় অংশ প্লাস্টিক ও পলিথিন। এটি প্রায় ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্জ্য সংগ্রহ এবং পুনর্ব্যবহার করা একটি নিয়মিত কার্যক্রম।
সাধারণত দেখা যায় উৎস পয়েন্ট হতে বর্জ্য সংগ্রহকারীরা প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন খোলা উৎস হতে অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্লাস্টিক বা পলিথিন বর্জ্য সংগ্রহ করেন। সংগৃহীত বর্জ্য ছোট ভাঙাড়ির দোকানে বিক্রি করা হয়। তার পর ছোট ভাঙাড়িরা প্লাস্টিক রিসাইক্লারের কাছে বিক্রি করে। সর্বশেষ রিসাইক্লাররা প্রক্রিয়াজাত প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্লাস্টিক প্রস্তুতকারকের কাছে বিক্রি করে, আর এভাবে চট্টগ্রামে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে প্রায় ৩০০ প্লাস্টিক রিসাইক্লার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া বাসা-বাড়ি থেকে লাল, হলুদ ও সবুজ তিন পাত্রের মাধ্যমে বর্জ্য সংগ্রহ করে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা। এ সময় পচন ও অপচনশীল বর্জ্য আলাদা মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। এতে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য পৃথক পাত্রের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তরা জানান।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বর্জ্য বাছাইকারীরা (সেবক) পলিথিন বর্জ্য (পিপি) সংগ্রহ করতে চায় না। কারণ এসব পলিথিন হালকা এবং অর্থনৈতিক মূল্য কম। বর্জ্য সংগ্রহকারীরা মনে করে উৎস পয়েন্ট (বাসাবাড়ি, এসটিএস, ডাম্পিং পয়েন্ট) হতে সারা দিনে তিন থেকে চার কেজির বেশি পলিথিন বর্জ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। তা ছাড়া বেশির ভাগ পলিথিন ময়লাযুক্ত থাকে।
এসব ময়লাযুক্ত পলিথিন স্ক্র্যাপ বা ভাঙাড়ি ব্যবসায়ীরা ক্রয় করতে অনাগ্রহ দেখিয়ে থাকেন। এসব কারণে চট্টগ্রাম শহরে পলিথিন বর্জ্য সংগ্রহ কম হয়ে থাকে। অসংগৃহীত পলিথিন বর্জ্যসমূহ শহরের বিভিন্ন জায়গা (নালা, নর্দমা, ডুবা, ড্রেইন ও রাস্তায়) পরে থাকতে দেখা যায়। যার ফলে এই সব পলিথিনের শেষ পরিণয় হয়ে থাকে খাল, নদী ও সাগর। ফলশ্রুতিতে শহরের সামান্য বৃষ্টিতে ব্যাপক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় ও পরিবেশ দূষিত হয়।
তাই এসব পরিত্যক্ত পলিথিন বা প্লাস্টিক বর্জ্য শহর থেকে সংগ্রহ করা এবং প্লাস্টিক রিসাইক্লারদের নিকট পৌঁছানোর জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। প্রাথমিকভাবে তিন ওয়ার্ডে আদর্শ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এই পদ্ধতিতে তিনটি নির্দেশনা স্থানীয়দের দেওয়া হয়। এগুলো হলো-ড্রেন, নালাসহ যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকা; নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ময়লা আবর্জনা ফেলা; প্রতিদিন বিকেল ৪টার মধ্যে সিটি করপোরেশন ময়লা সংগ্রহ করবে, এর আগেই বাসাবাড়ি জমানো ময়লা ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় সফলতা পাওয়ায় এখন পুরো ৪১টি ওয়ার্ডে কার্যক্রম শুরু হয়েছে।’ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আদর্শ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এই পদ্ধতি বেসরকারিভাবে স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা) ও ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড সহায়তা করছে বলে জানান তিনি।
সরেজমিনে চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনের সাত নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বাসা-বাড়িতে বর্জ্য সংগ্রহের জন্য তিনটি পাত্র রয়েছে। এ সব পাত্রে আলাদা করে বর্জ্য রাখে স্থানীয়রা। বহুতল ভবনে নিচতলায় তিনটি বড় বড় পাত্র রাখা আছে। এ সব পাত্রে স্থানীয় বাসিন্দারা পচনশীল, অপচনশীল (প্লাস্টিক ও পলিথিন) ও ঝুঁকিপূর্ণ কঠিন বর্জ্য রাখা হয়। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় সিটি করপোরেশনের বর্জ্য সংগ্রহকারীরা তা নিয়ে যায় বলে স্থানীয়রা জানান।
এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা জোসনা আক্তার মিম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আগে আমরা সব ময়লা এক পাত্রে রাখতাম। মাছ কাঁটা ও সবজি কাঁটাসহ পচনশীল ও অপচনশীল সব ময়লা একসঙ্গে এক পাত্রে রাখা হতো। এখন তা করা হয় না। পঁচনশীল ও অপচনশীল ময়লা পৃথকভাবে রাখা হয়। এ ছাড়া প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন পৃথক পাত্রে রাখা হয়। প্রতিদিনের ময়লাগুলো সিটি করপোশেনের কর্মীরা এসে নিয়ে যায়। তবে প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন এক সঙ্গে অনেকগুলো জমা হলে কাজের বুয়ারা তা সংগ্রহ করে বিক্রি করে।’ আগে এগুলো এত গুরুত্ব দেওয়া হতো না বলে জানান।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাত নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মোবারক আলী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ইপসা ও ইউনিলিভারের সহায়তায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে। উক্ত প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য পৃথকীকরণে গৃহস্থালি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, বর্জ্য সংগ্রহকারীদের প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য সংগ্রহে অনুপ্রাণিত করা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ওয়ার্ডভিত্তিক মডেল তৈরি করা, সরকারের অ্যাকশান প্লান ফর প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট (২০২১-২০৩০) বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা, বাজারে ভার্জিন প্লাস্টিকের অনুপ্রবেশ কমিয়ে আনা এবং চট্টগ্রাম শহরের পরিবেশ উন্নত করা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের যৌথ উদ্যোগে চট্টগ্রাম নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’
প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য সংগ্রহে প্রণোদনা
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য সংগ্রহের পর তা ক্রয় ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রণোদনা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা)’র মাধ্যমে আর্থিকভাবে এই সহযোগিতা করছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড। ওয়ার্ড পর্যায়ে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য সংগ্রহকারীদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য এই প্রণোদনা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্লাস্টিক ও পলিথিন সংগ্রহকারীকে বর্জ্য বিক্রয়ের সময় প্রতি কেজিতে দুই টাকা এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতি কেজিতে ১ টাকা দেয়া হয় ভাঙাড়ি দোকারদারকে। তাই প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য ক্রয়-বিক্রয়ে প্রতি কেজিতে ৩ টা করে প্রণোদনা দেওয়া হয় ইপসার কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে ইপসার প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের ফোকাল কর্মকর্তা মো. আব্দুস সবুর জনকণ্ঠকে বলেন, ‘প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য সংগ্রহের উৎসাহ বাড়ানোর জন্য এই প্রণোদনা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। প্রতি মাসের মাঝামাঝি সময় বর্জ্য ক্রয় ও বিক্রয়ে ক্ষেত্রে প্রতি কেজিতে ৩ টাকা করে প্রণোদনা দেয়া হয়। এই প্রণোদনার অর্থ সরাসরি বিকাশ ও ব্যাংক একাউন্টারের মাধ্যমে বর্জ্য সংগ্রহকারী ও ভাঙ্গারী দোকানদারের কাছে পৌঁছানো হয়। ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের সহায়তায় প্রতিমাসে ২০০ জন ভাঙাড়ি দোকানদার ও প্রায় ২৫০০ জন বর্জ্য সংগ্রহকারীকে এই প্রণোদনা দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে ইউনিলিভার বাংলাদেশের পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, পার্টনারশিপ অ্যান্ড কমিউনিকেশনস) শামিমা আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ইউনিলিভার বাংলাদেশ একটি ভোক্তা পণ্য কোম্পানি হিসেবে প্লাস্টিক বর্জ্যরে জন্য কিছুটা হলেও দায়ী। তাই নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকে প্লাস্টিক বর্জ্যমুক্ত ভবিষ্যত গঠনের লক্ষ্যে মডেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হয়েছে।
২০২৫ সালের মধ্যে আমাদের পণ্যের প্যাকেজিংয়ে ৫০ শতাংশ ভার্জিন প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনা হবে। পাশাপাশি প্লাস্টিক বা পলিথিন রিসাইক্লারিংয়ের মাধ্যমে প্যাকেজিংয়ে তা পুনব্যৃবহার করা হবে। বাংলাদেশে ২০২০ সাল থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উদ্ভাবনী পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহের একটি মডেল তৈরি করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’ তাই মডেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অন্যান্য বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
এস