ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ঢাকায় ৪৪টি সিনেমা হলের মধ্যে চালু আছে হাতেগোনা কয়েকটি

মানসম্মত সিনেমার অভাবে বন্ধ হচ্ছে হল

গৌতম পান্ডে

প্রকাশিত: ২২:৩৭, ১৩ জুন ২০২৫

মানসম্মত সিনেমার অভাবে বন্ধ হচ্ছে হল

.

ঈদ কেন্দ্রিক হয়ে গেছে দেশের চলচ্চিত্র। সারা বছর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললেও ঈদের সময় চলচ্চিত্র মুক্তির প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। তখন সিনেমা হল মালিকরাও নড়েচড়ে বসেন। ঘষে মেজে হলের সংস্কারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। প্রশ্ন হচ্ছে এভাবে কি একটা দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব? শুধুমাত্র সিনেপ্লেক্স দিয়ে কি একটি দেশের চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নেওয়া যায়? পৃথিবীর অন্য দেশ যখন চলচ্চিত্র শিল্পকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের চলচ্চিত্র দিনকে দিন ধ্বংসের মুখে ধাবিত হচ্ছে। দেশের চলচ্চিত্র শিল্প সংকটকাল অতিক্রম করছে এটাই বাস্তবতা। দর্শক শূন্যতা ও ব্যবসায়িক লোকসানের মুখে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে সিনেমা হল। ঢাকার সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ৪৪টি। এর মধ্যে বড় সিনেমা হলগুলোর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি চালু আছে। ২০১৯ সালে ফিল্মপাড়া’খ্যাত কাকরাইলের রাজমণি সিনেমা হলের বাতি নিভে যায়। বর্তমানে সেখানে ২২ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মিত হচ্ছে। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজধানীর হাজার আসনের সিনেমা হল অভিসারও বন্ধ হয়ে গেছে। ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়েছে গুলিস্তান, বিউটি, রূপমহল, নাজ, শাবিস্তান, মল্লিকা, পূরবী, স্টার, সুরমা, লায়ন, যমুনা, আগমন, ডায়না, জোনাকি, চিত্রামহল, অতিথি, মানসী, পূর্ণিমা, পদ্মা, মুন’সহ অনেক সিনেমা হল। দেশে চৌদ্দশ হলের এখন বাকি আছে দেড়শ’র মতো। বাকি হল মালিকদের মুখেও বিদায়ের সুর। কোন কোন জেলা শহরে সিনেমা হলই বিলুপ্ত। লোকশানের বোঝা বইতে না পেরে প্রযোজকরা সিনেমায় টাকা লগ্নি করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
চলচ্চিত্রের এই করুণ পরিণতির জন্য প্রযোজক-পরিচালক দায়ী করছে হল মালিকদের। অন্যদিকে হল মালিকরা অভিযোগ তুলছে মানহীন ছবিতে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আবার চলচ্চিত্র শিল্পীরা ছবি প্রদর্শনের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছে। চলচ্চিত্রশংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছে, এর দায় সরকারের। সিনেমা হল মালিকরা মনে করছেন, দেশে ভালো সিনেমা তৈরি হচ্ছে না। যার জন্য দর্শক হলমুখী হচ্ছে না।
দেশের সিনেমা হলগুলো কেন বন্ধ হচ্ছে এম প্রশ্নে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হল মুধুমিতার কর্ণধার ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ জনকণ্ঠকে বলেন, মধুমিতা সিনেমা হল ঐতিহ্যের প্রতীক। কষ্ট হলেও এ ঐতিহ্যকে এখনো ধরে রেখেছি। আপাতত রবিবার থেকে আমার হলে ছবি দেখানো বন্ধ করেছি। গত ঈদে ‘বরবাদ’ দেখিয়েছিলাম। বেশ কিছুদিন দেখানোর পর এখন আর দর্শক নেই সে কারণে আপাতত বন্ধ। এই ঈদে আবার চলছে। এবার ‘তা-ব’ সিনেমা দেখাচ্ছি। সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রশ্নে তিনি বলেন, ভালো ছবির অভাব। ভালো কোনো কণ্টেন্ট নেই। মাত্র দুই ঈদে ছবি আসে, অন্য সময় নেই, এভাবে তো আর চলচ্চিত্র টিকে রাখা সম্ভব না। তিনি বলেন, ঈদের পরে দুই একটা ছবি এলেও খুবই নি¤œ মানের। এগুলো দর্শক দেখে না। আগে তো আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে এমন অবস্থা ছিল না। আমি মনে করি আমাদের দেশে অনেক মেধা আছে, ছবি তৈরির সামর্থ্যও আছে কিন্তু প্রডিউসাররা এখন টাকা খরচ করতে চায় না। যার ফলে হলের সংখ্যা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। পয়সা লগ্নি করলে তা আর উঠে আসে না। এখন হল টিকিয়ে রাখতে হলে সুপার-ডুপার ছবি বানাতে হবে, নচেৎ ভবিষ্যতে আরও সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাবে। সারা বাংলাদেশে সকল হল মালিকদের কষ্ট হচ্ছে। পকেটের টাকা খরচ করে হল টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে তাই অনেক সময় মাথা গরম হয়ে যায় তাই হয়তো বলে ফেলি হল রাখব না। তার মানে এই না সত্যি সেটা করছি।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্ট সুদীপ্ত কুমার দাশ জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশে কেন সিনেমা হল বন্ধ হচ্ছে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কিছুটা পেছনে ফিরে যেতে হবে। আমাদের দেশে সিনেমার সোনালি দিনে হলের সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ১২৩৫টার মতো। সর্বশেষ ১৯৯২-৯৮ অর্থবছরে রাজস্ব বোর্ডের সিহাব অনুযায়ী হল মালিকরা রেগুলার ট্যাক্স পে করত। পরবর্তীতে এর সঙ্গে ভ্যাট যোগ করা হলো। শুল্ক ও ভ্যাট মিলে একশ তেরো শতাংশ করা হয়। যে কারণে সিনেমা হলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি আকাশ উন্মুক্ত করে দিল অর্থাৎ কোনো রকম কোনো নিয়ম নীতিমালা অনুসরণ না করেই ডিস এন্টোর মাধ্যমে টেলিভিশনে ছবি দেখার সুযোগ করে দেওয়া হলো। ১৯৯৪/৯৫ সালের দিকে এসে এটা যখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেল, সিনেমার দর্শক যারা পরিবার নিয়ে অথবা একসঙ্গে দশ পনেরো জন মিলে হলে গিয়ে নিয়মিত সিনেমা দেখত, সেই দর্শক হলে আসা বন্ধ করে দিল। কারণ, ঘরে বসে ভারতীয় অনেক জনপ্রিয় ছবি দেখার সুযোগ পেল দর্শক। ভারতীয় ছবির অনুকরণে আমাদের দেশের ছবি দেখার তেমন আগ্রহ দর্শকের ছিল না। তবে মাঝে মধ্যে হলে দর্শক আসত, যখন যে ছবিগুলো ছিল একেবারে মৌলিক ও সোশ্যাল সেন্টিমেন্টের সেগুলো ফ্যামিলি দর্শক দেখত। কিন্তু সেটার পরিমাণ একেবারেই কম। যে কারণে সিনেমা হলের ইনকাম কমতে থাকে। পাশাপাশি সরকারি ট্যাক্স আদায়ও কমতে থাকে। আমাদের কাছে যে হিসাব আছে তাতে দেখা যায়, ১৯৯৬-৯৭ সালে ট্যাক্স আদায় কমতে থাকে। ২০০০ সালে এসে একেবারে ২০ পর্সেন্টে নেমে যায়। এই অবস্থায় ২০০২ সাল থেকে সিনেমা হল বন্ধ হওযা শুরু হয়। যখন হল বন্ধ হওয়া শুরু হলো তখন আমাদের ছবিগুলোর জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। কারণ ডিস এন্টেনা দিয়ে যে ছবি দেখে, সেই ছবিরই রিমেক দেখে হলগুলোতে। সেই কারণে দর্শকের আকর্ষণ হলের প্রতি অনেক কমে গেল। যার ফলে এক শ্রেণির প্রযোজক ও পরিচালক এই দুর্বলতার সুযোগে নোংরা যাকে বলে অশ্লিল ছবি তৈরি শুরু করে। এতে প্রথমে কিছু ভালোগার দৃশ্য থাকত, যে অংশ সেন্সরবোর্ড কেটে দিত, সেই দুশ্যগুলো চুপচাপ প্রিন্টের সঙ্গে জুড়ে দিত। এভাবেই শুরু হলো অশ্লিল নোংরা ছবির রাজত্ব। একপর্যায়ে সরাসরি স্যুট করত অশ্লিল দৃশ্য। এগুলো ছবির সঙ্গে লাগিয়ে দিত। এই ছবিগুলো যখন সিনেমা হলে চালানো শুরু হলো, তখন ফ্যামিলি দর্শক টোটাল হল বিমুখ হয়ে গেল। এটা আমাদের চলচ্চিত্রটাকে ধস নামিয়েছে। এটাই হচ্ছে, প্রধান কারণ। এর পওে তো পাইরেসিসহ আরও কিছু কিছু বিষয় আছে। দুদিন পরেই টিভিতে দেখা যেত পাইরেটেড ছবি। লোকাল ছবিগুলো দারুণভাবে লোকসানের মুখে পড়ে যায়। এ কারণেই আমাদের এই ব্যবসাটা মুখ থুবড়ে পড়ে।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল জনকণ্ঠকে বলেন, চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরে আসছে আমরা মনে করছি। তার কারণ কিছু কিছু ছবি এখন বেশ ভালো হচ্ছে, যা দর্শককে হলমুখী করছে। তবে এটা দুই ঈদ কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। আমরা আশা করছি এবার ঈদে ভালো ভালো ছবি আসবে। যদি আসে তাহলে নতুন করে হলগুলো খুলবে। এ রকম যদি সারা বছর চলে তাহলে হলগুলোকে ধরে রাখা সম্ভব হবে। শুধুমাত্র ঈদের জন্য ছবি দিল প্রযোজকরা কিন্তু ঈদের পরে আর ভালো কোনো ছবি না থাকে তাহলে তো হল ধরে রাখা যাবে না। আমরা প্রযোজকদের কাছে ও পরিচালকদের কাছে অনুরোধ করব দর্শক যাতে হলে গিয়ে ছবি দেখতে পারে তারা যেন সারা বছর এ রকম ভালো ভালো ছবি তৈরি করে। আমরা হল থেকে সার্বিক সহযোগিতা করব। পাশাপাশি বলব শুধু ঈদের ছবি দিলে হবে না, সারা বছর ছবি দিতে হবে।

প্যানেল

×