
ছবি: সংগৃহীত, পিকে রোজির কোনও যাচাইকৃত ছবি না থাকায়, বিবিসি এই ছবিটি তৈরি করেছে
এক শতাব্দী আগে, যখন ভারতে নারীদের চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণ সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না, তখন এক সাহসী তরুণী সেই বাধা ভেঙে পা রাখেন অভিনয়ের জগতে। দক্ষিণ ভারতের কেরালার এক নিম্নবর্ণের তরুণী পি কে রোজি ছিলেন মালায়ালম চলচ্চিত্রের প্রথম অভিনেত্রী।
১৯২০-এর দশকে নির্মিত প্রথম মালায়ালম সিনেমা বিগাথাকুমারান (অর্থাৎ “হারানো শিশু”) তে তিনি অভিনয় করেন। কিন্তু সমাজ তাকে সাদরে গ্রহণ করেনি; বরং তার পরিচয়, অর্জন এবং ইতিহাসকে মুছে দেওয়া হয় জাতপাতের নির্মম বৈষম্যের কারণে।
পি কে রোজি, তৎকালীন ত্রাভাঙ্কোর রাজ্যে (বর্তমান কেরালা) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ভারতের জাত প্রথার সবচেয়ে নিপীড়িত গোষ্ঠী পুলায়া সম্প্রদায়ের একজন।
কান্নুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মালবিকা বিনি বলেন,“পুলায়া সম্প্রদায়ের মানুষদের দাস হিসেবে গণ্য করা হতো, ভূমির সঙ্গে তাদেরও নিলামে তোলা হতো,” । তবুও চরম বৈষম্যের মধ্যেও রোজি অভিনয়ের স্বপ্ন দেখেন। চাচার সহযোগিতায় স্থানীয় থিয়েটারে অভিনয় শুরু করেন এবং পরে বিখ্যাত পরিচালক জে সি ড্যানিয়েলের নজরে আসেন।
ড্যানিয়েল তার সিনেমা বিগাথাকুমারান-এ ‘সারোজিনী’ চরিত্রের জন্য রোজিকে বেছে নেন, যদিও তিনি তার জাতপরিচয় জানতেন। ১০ দিনের শুটিংয়ে রোসিকে প্রতিদিন ৫ টাকা করে পারিশ্রমিক দেওয়া হয় — যা সেই সময়ে একটি বড় অঙ্কের অর্থ ছিল।
তবে সিনেমার মুক্তির দিনেই ঘটে চরম অপমানজনক ঘটনা। জাতপাতের কারণে রোজি ও তার পরিবারকে সিনেমা হলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তার চেয়ে বড় ধাক্কা আসে দর্শকদের প্রতিক্রিয়ায়।
সিনেমায় এক দৃশ্যে নায়ক নায়িকার চুল থেকে ফুল তুলে চুমু খাওয়ায় ক্ষুব্ধ দর্শকরা পর্দায় ইট-পাটকেল ছোঁড়ে এবং পরিচালক ড্যানিয়েলকে ধাওয়া করে।
পরিণামে, সিনেমাটি ধ্বংস হয়, রোজি পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। উত্তপ্ত জনতা তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আত্মরক্ষার তাগিদে তিনি তামিলনাড়ুর নাগারকোইলে এক উচ্চবর্ণের ব্যক্তিকে বিয়ে করে নাম পাল্টে ‘রাজাম্মল’ হয়ে যান এবং নিভৃতে জীবন যাপন করেন।
তার সন্তানরা কখনও মেনে নেয়নি যে পি কে রোজি তাদের মা ছিলেন। রোজির ভাগ্নে বিজু গোবিন্দন বলেন, “তারা তাদের বাবার জাতপরিচয় বেছে নিয়েছে, মায়ের নয়। তাই আমাদের পরিবারের কোনো স্থান তাদের জীবনে নেই।”
সম্প্রতি দলিত অধিকারকর্মী ও চলচ্চিত্র নির্মাতারা রোজির অবদানকে পুনরুদ্ধারে উদ্যোগ নিয়েছেন। বিখ্যাত তামিল পরিচালক পা. রঞ্জিত তার নামে একটি বাৎসরিক চলচ্চিত্র উৎসব শুরু করেছেন, যেখানে দলিত (দলিত শব্দের দ্বারা ভারত-এর এমন কিছু জাতিগত গোষ্ঠীকে বোঝানো হয় যারা সচরাচর নিপীড়িত) চলচ্চিত্রকারদের কাজ প্রদর্শিত হয়।
তবে এখনও রোজির কোনো নিশ্চিত ছবি বা সিনেমার ফুটেজ অবশিষ্ট নেই। রোজির জীবন ও নিঃশব্দ প্রতিবাদ নিয়ে বই লিখেছেন ভিনু আব্রাহাম, যার নাম দ্যা লস্ট হিরোইন। অধ্যাপক বিনি বলেন, “রোজি হয়তো বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু ত্যাগ করেছিলেন নিজের শিল্প ও পরিচয়। এটা তার নয়, বরং সমাজের ব্যর্থতা।"
মুমু