
ছবি: সংগৃহীত।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ২০২৪-২৫ অর্থবছরের কম্পিউটার সরবরাহ কাজের টেন্ডার আইন অমান্য করে এক প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করার অভিযোগের প্রমান পেয়েছে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ)। এর প্রেক্ষিতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ৯ লাখ ৯৪ হাজার ৩৫০ টাকা।
এছাড়া সংস্থাটি আরো জানায়, এই টেন্ডার প্রসঙ্গে মূল্যায়ন কমিটি স্বচ্ছতার পরিচয় দেয়নি। এর ফলে সরকারের যে ৯ লাখ ৯৪ হাজার ৩৫০ টাকা ক্ষতি হয়েছে, এই ক্ষতি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের ব্যক্তিগত দায় হিসেবে গণ্য হবে।
গত বছরের ২২ ডিসেম্বর কম্পিউটার সরবরাহের জন্য (ইজিপি দরপত্র নং- ১০৫৪১৫৬) একটি বিজ্ঞপ্তি প্রদান করা হয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে ওয়াল্টন ডিজি-টেক ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড, সফট টেক, স্মার্ট টেকনোলজি (বিডি) লিমিটেড, ক্রিয়েচার কম্পিউটারস এবং গ্লোবাল ব্র্যান্ড লিমিটেড সহ মোট সাতটি প্রতিষ্ঠান টেন্ডার জমা দেয়।
অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের দরপত্র ও দাখিলকৃত কাগজপত্রাদির বিবরণী শিটের তথ্যমতে, ওয়াল্টন কর্তৃপক্ষ ৪৬ লাখ ৪০ হাজার ৫৫০টাকায় কম্পিউটার সরবরাহের কথা জানায়, সফট টেক ৫৫ লাখ ৯১ হাজার ৯০০ টাকায়, স্মার্ট টেক ৫৬ লাখ ৩৪ হাজার ৯০০ টাকায়, ক্রিয়েচার কম্পিউটার ৫৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকায় এবং গ্লোবাল ব্রেন্ড প্রায় ৫৯ লাখ টাকায়।
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ এর ধারা ৪৮ (২) অনুযায়ী, দরপত্র দাখিলকৃত প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সর্বনিম্ন দরপত্র দাখিলকৃত প্রতিষ্ঠানটি দরপত্রটি পেয়ে থাকে। তবে ইজিপি দরপত্র নং- ১০৫৪১৫৬ টেন্ডারটি ওয়াল্টন সর্বনিম্ন দরপত্র দাখিল করা সত্ত্বেও তাদের দেওয়া হয়নি। টেন্ডারটি প্রদান করা হয়েছে সর্বনিম্ন দরপত্রদের মধ্যে তিনে থাকা স্মার্ট টেকনোলজিকে।
সর্বনিম্ন দরপত্র দাখিল করা সত্ত্বেও তাদের বিবেচনা না করায় বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) বরাবর গত ২ ফেব্রুয়ারি ওয়াল্টন ডিজি-টেকের চিফ বিজনেস অফিসার মোঃ তৌহিদুর রহমান রাদের স্বাক্ষরে বাংলাদেশ প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর বিধি ৫৬ অনুযায়ী 'দরপত্র কার্যাদেশ' সংক্রান্ত এক অভিযোগ দায়ের করা হয়।
অভিযোগ পত্রে বলা হয়, দরপত্র মোতাবেক শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে তাদের বিবেচনা করা হয়নি। এছাড়া কারিগরি বিনির্দেশ পূরণ করা সত্ত্বেও পিপিআর (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস) ও পিপিএ (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট) বিধিভুক্ত নয় এমন কোনো কারণ উপস্থাপন ও বিবেচনা না করার কার্যাদেশ দেওয়ার আগে তাদের জানানো হয়নি।
এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ২১ এপ্রিল রিভিউ প্যানেল-৩ এর চেয়ারপারসন মোঃ আলী কদর, সদস্য মোঃ সফিকুল ইসলাম এবং আরেক সদস্য মোঃ আলমগীর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, এই টেন্ডার প্রসঙ্গে মূল্যায়ন কমিটি স্বচ্ছতার পরিচয় দেয়নি। এর ফলে সরকারের ৯ লাখ ৯৪ হাজার ৩৫০ টাকা সরকারের ক্ষতি হয়েছে। আর এই ক্ষতি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের ব্যক্তিগত দায় হিসেবে গণ্য হবে।
এছাড়া চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, পিপিএ-২০০৬ এর ধারা (৭) অনুযায়ী ক্রয়কারী দরপত্র মূল্যায়নের জন্য তার কার্যালয় বহির্ভূত কারিগরি, আর্থিক বা আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ কোন কর্মকর্তার সমন্বয়ে দরপত্র বা প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটি গঠন করেনি। তবে যেহেতু ক্রয় প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যেই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে, সেহেতু দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যগণের নিকট হতে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮ এর বিধি ৬০ (৩) (ঙ) অনুযায়ী আপিলকারী ক্ষতিপূরণ পেতে হকদার মর্মে সিদ্ধান্ত প্রদান করা গেল এবং অত্র আপীল আংশিক মঞ্জুরযোগ্য মর্মে সিদ্ধান্ত প্রদান করা হলো।
এছাড়া এই রায় অনুযায়ী, আপিলকারী পিপিআর বিধিমালা, ২০০৮ এর ৬০ (৩) (৫) বিধি মোতাবেক সংশ্লিষ্ট দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির নিকট ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারেন। এছাড়া কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এ ধরণের ক্রয়ের ক্ষেত্রে আরো সতর্ক থাকতে এবং মূল্যায়ন কমিটি গঠনের সময় আবশ্যিকভাবে বহিঃসদস্য অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য নির্দেশনা প্রদান করে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আপিলকারীর নিরাপত্তা জামানত ফেরত দেয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
সামগ্রিক ব্যাপারে ওয়াল্টন ডিজি-টেকের চিফ বিজনেস অফিসার ও অভিযোগকারী তৌহিদুর রহমান রাদ বলেন, 'আমরা বাংলাদেশ সংবিধানের নীতিমালা অনুযায়ী সিপিটিইউ বরাবর অভিযোগ দেই। কিন্তু তাদের কাছ থেকে (বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন) আমরা কোনো রিপ্লাই পাই না। তারপর অটোমেটিক্যালি সিপিটিইউ এর যে সর্বোচ্চ একটা আইন আছে সেটা অনুযায়ী তারা চেয়ারপারসনের নেতৃত্বে একটা আদালত গঠন করে।'
তিনি আরও বলেন, 'আদালত গঠন করার পরে সবাই ডকুমেন্টস দাখিল করে। ওয়াল্টনের পক্ষ থেকে আমরা করি এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তারা করে। তারপর একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে। এতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে ১০ লাখের মতো জরিমানা করা হয়েছে। আমরা সামনের দিনে নিয়ম মোতাবেক আগাব আরকি, আমাদের ইন্টারনাল সব কাজ চালু আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের যে আইন, যে সময়সীমা সেই অনুযায়ী আমাদের লিগ্যাল টিম কাজ করবে।'
তবে কুবির টেন্ডার প্রদান সংক্রান্ত 'কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি' ও 'দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের সাথে কথা বললে একজন আরেকজনের উপর দায় চাপিয়ে দেয় শুধু।
'কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি'তে আহবায়ক হিসেবে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের ডিন ও আইসিটি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. সাইফুর রহমান এবং সদস্য হিসেবে আছেন কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোঃ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ।
এছাড়া দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে আহবায়ক হিসেবে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলায়মান, সদস্য হিসেবে আছেন আইসিটি সেলের প্রোগ্রামার এ.এম.এম. সাইদুর রশিদ। এছাড়া এই টেন্ডারের প্রকিউরমেন্ট এনটিটি হিসেবে আছেন আইসিটি সেলের প্রধান মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন।
এই প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি দপ্তরের প্রধান ও এই টেন্ডারের প্রকিউরমেন্ট এনটিটি মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, 'আমি আসলে প্রত্যেক টেন্ডারের পিই হিসেবে মেম্বার। আমার মনে হয় এই বিষয়টি নিয়ে ট্রেজারার স্যার ভালো বলবেন।'
আপনি (মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন) তো এনটিটি এবং সদস্য হিসেবে আছেন এবং আইন ও নিয়ম অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরপত্র প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানই টেন্ডার পেয়ে থাকে, এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে আসলে কী বলবেন ? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'আমি আসলে সিপিটিইউ এর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত না। আমি টেন্ডারের সাথে থেকে থেকে, দেখে দেখে শিখেছি। তবে কম্পিউটার বা এই সংক্রান্ত ক্ষেত্রে একটা টিইসি (কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি) থাকে। আমরা যে স্পেসিফিকেশন দিছি এবং তারা যে স্পেসিফিকেশন টেন্ডারে উল্লেখ করছে এই ব্যাপারটা মূল্যায়ন করেছে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। তারা সাতটা প্রতিষ্ঠান থেকে তিনটা প্রতিষ্ঠানকে কারিগরি ত্রুটি দেখিয়ে স্কিপ করছে। এইখানে ওয়াল্টন আছে এবং আরও দুইটা।'
তিনি আরও বলেন, 'এরপরের কাজ আমাদের। আমরা চারটা থেকে দুইটা ঠিক করেছি এবং স্মার্ট টেককে দিয়েছি। এরপর যখন ওয়াল্টন আমাদের কাছে আসে তখন আমরা বলি যে, আপনাদের প্রোডাক্ট সম্পর্কে আমরা এত জানি না। আমরা যেটা চাচ্ছি আপনাদের প্রোডাক্ট যদি ওই সমমানেরই হয় তাহলে সব স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে একটা সেমিনার টাইপ কিছু করে সবাইকে ধারণা দেন। এর যখন সিপিটিইউ থেকে কাগজ আসে তখন ভিসি স্যার আমাকে পাঠায় এবং ওইখানে লিখা আছে যে এটার দায় কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি উপর বর্তায়।'
এ ব্যাপারে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির আহবায়ক ও প্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. সাইফুর রহমান বলেন, 'আমাদের ত টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো দেখার রাইটস আছে। আমাদের কাছে ত প্রাইস বা অন্যকিছু দেখার ব্যাপার থাকে না। আমরা টেকনিক্যাল বিষয়গুলো দেখেই পাঠিয়ে দেই। এরপর সবকিছু ইভ্যালুয়েশন (দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি) কমিটি দেখে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পেসিফিকেশন কমিটি থাকে এবং কোম্পানির স্পেসিফিকেশন থাকে। ওইখানে প্রাইস জানার উপায় থাকে না। আমরা না জানি প্রাইস না জানি অন্য কিছু। তাহলে আমাদের উপর কিভাবে দায় আসে? এটা তারাই (দরপত্র মুল্লায়ন কমিটি) ভালো বলতে পারবে।'
এ ব্যাপারে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আহবায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, 'আসলে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই এইগুলোর কাজ শুরু হয়। আমরা তো এক্সপার্ট না, নতুন। টেকনিক্যাল কমিটি পর্যালোচনা করার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। এরপর ওয়াল্টন আমাদের আর কিছু জানায়নি। তারা আমাদের কিছু জানালে এর প্রেক্ষিতে আমরা আমাদের বক্তব্য দিব। আপিলের সুযোগ থাকলে করব। তবে যে সমস্যাগুলো হয়েছে সামনের দিনে হবে না আশা করি। এক্সপার্টদের নিয়েই পর্যালোচনা করে এই কাজগুলো করা হবে।'
সার্বিক ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ হায়দার আলী বলেন, 'নিয়ম অনুয়ায়ী লেখা ছিল যে ইন্টারন্যাশনালি রেপুটেড প্রতিষ্ঠান। এখন ওয়াল্টন দেশীয় কোম্পানি বলে বাদ দিয়েছে, আবার ওয়াল্টন দাবি করেছে তারা ইন্টারন্যাশনালি রেপুটেড। এখন যারা এই কাজ করেছে, এই ৯ লাখ ৯৪ হাজার টাকার পুরোটা তাদের দিতে হবে। রায় হয়ে গেছে। তিন জন মনে হয় এই কমিটির মেম্বার, এখন এই টাকা তাদের পকেট থেকে দিতে হবে। এইখানে বিশ্ববিদ্যালয় টাকা দিবে না।'
নুসরাত