শেয়ারবাজারে কারসাজি রোধে কঠোর অবস্থানে বিএসইসি
শেয়ারবাজারে কারসাজি রোধে কঠোর অবস্থানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। গত দুই বছরে তালিকাভুক্ত বেশ কিছু কোম্পানির দর ও লেনদেন বৃদ্ধির ঘটনায় অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রমাণ পেয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে সংস্থাটি। কৃত্রিমভাবে দর বাড়ানোর জন্য আলোচিত কয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে কমিশন। সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় আলোচিত-সমালোচিত বিনিয়োগকারী আবুল খায়ের হিরু ও পরিবারের সদস্যের বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ পেয়ে ১০ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করা হয়েছে।
আবুল খায়ের হিরুর ব্যবসায়িক পার্টনার তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ যাচাই-বাছাইয়ের পর তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সাকিব আল হাসানের নাম আলোচনায় আসলেও এবার তাঁর ও প্রতিষ্ঠানের নাম সরাসরি ঢাকা স্টক একচেঞ্জের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর কমিশন অভিযুক্তদের শুনানিতে ডাকে। শুনানি শেষে কমিশন হিরু ও তার পরিবারের সদস্যদের ১০ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করে কমিশন। অভিযুক্তদের ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে বিএসইসির অনুকূলে ইস্যুকৃত ব্যাংক ড্রাফট/ পে অর্ডারের মাধ্যমে জমা করতে হবে। অন্যথায় কমিশন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। তবে অভিযুক্ত চাইলে জরিমানার বিরুদ্ধে কমিশনে রিভিউ আপীল করতে পারবে। রিভিউ আবেদন করলে শুনানী শেষে কমিশন পুনরায় সিদ্ধান্ত নেবে।
জানা গেছে, সাত কোম্পানির শেয়ারে দাম বাড়ানোর চক্রটি ১৩৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বলে বিএসইসির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এই তালিকায় দেশসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নাম ছিল। বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট বিভাগের প্রতিবেদনে কমপক্ষে দুটিতে সাকিবের বিও হিসাবের কথা উল্লেখ আছে। আর কয়েকটির মধ্যে তার মালিকানাধীন কোম্পানি মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেডের নাম এসেছে।
প্রতিবেদনে মূল অভিযুক্ত শেয়ারবাজারে আলোচিত বিনিয়োগকারী আবুল খায়ের হিরু। সমবায় অধিদফতরের প্রথম শ্রেণীর এই কর্মকর্তার ব্যবসায়িক পার্টনার সাকিব আল হাসান। মোনার্ক হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান হিসেবে সাকিব আল হাসানের নাম রয়েছে। আর প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন হিরুর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান। সাদিয়া হাসানের নামও প্রতিবেদনে রয়েছে। তাঁকেও জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া নাম এসেছে হিরুর পিতা ও বোনের।
তদন্ত প্রতিবেদনে মূল অভিযুক্ত আবুল খায়ের হিরু বলেন, শেয়ারবাজারে গতি ফেরাতে সব ধরনের বিনিয়োগকারী সক্রিয় করতে বেশি লেনদেন করতে হয়েছে। মূলত বাজারকে সাপোর্ট দিতে নির্দিষ্ট কোম্পানি শেয়ার কিনতে হয়েছে। কমিশনের শুনানিতে এই বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, হিরুর মালিকানাধীন দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভ লিমিটেড এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েট এশিয়ান ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এই কারসাজির সহযোগী হিসেবে সাকিবের নাম এসেছে। হিরুর মালিকানাধীন এই কোম্পানি যখন শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়েছে, সেখানে অবদান ছিল সাকিবেরও। এ ছাড়া আবুল খায়েরের বোন কনিকা আফরোজ এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটের সঙ্গে এক জায়গায় ও আবুল খায়েরের বাবা আবুল কালাম মাতবর এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটের সঙ্গে দুই জায়গায় সহযোগী হিসেবে সাকিবের নাম পাওয়া যায়। এসব কারসাজির জন্য বিএসইসি মোট ১০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। তবে এই তালিকায় ছাড় পেয়েছেন সাকিব।
বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট বিভাগের চলতি বছরের ২০ জুনের চিঠি থেকে জানা যায়, আবুল খায়েরের মালিকানাধীন দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভ লিমিটেড এশিয়ান ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে। ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ অক্টোবরের মধ্যে এশিয়ান ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভ লিমিটেড। এ সময় বিমা কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৩০ টাকা ৭০ পয়সা থেকে ৬৮ টাকা ৬০ পয়সা হয়। এতে তারা মুনাফা করে ৩ কোটি ২৪ লাখ ৮৫ হাজার ৪২ টাকা। এ সময় তাদের আনরিয়েলাইজড গেইন বা সম্ভাব্য মুনাফা ছিল ৫ কোটি ২৪ লাখ ২১ হাজার ২২৫ টাকা। পরে আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভকে জরিমানা করা হয়েছে ৭২ লাখ টাকা।
গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনাটি ঘটে হিরুর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটের নামে। ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ৬ জুনের মধ্যে বীমা কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে কাজী সাদিয়া হাসান এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েট। এ সময় তারা মুনাফা করে ১ কোটি ৮৮ লাখ ২৮ হাজার ১৪ টাকা। এ সময় তাদের আনরিয়েলাইজড গেইন হয় ৫৭ লাখ ২৮ হাজার ৪৯১ টাকা। কারসাজির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পরে কাজী সাদিয়া হাসান এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটকে জরিমানা করা হয় ৪২ লাখ টাকা।
২০২১ সালের ৪ এপ্রিল থেকে ৩ মের মধ্যে ঢাকা ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে কাজী সাদিয়া হাসান এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েট। এ সময় তারা মুনাফা করে (রিয়েলাইজড গেইন) ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৬১ হাজার ৪০৫ টাকা। আর আনরিয়েলাইজড গেইন ছিল ৯৫ লাখ ৫১ হাজার ৭০৫ টাকা। পরে প্রতিষ্ঠানটিকে জরিমানা করা হয়েছে ৯৫ লাখ টাকা।
এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার নিয়েও কারসাজি করে চক্রটি। বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট বিভাগের গত ৬ জুলাইয়ের চিঠি থেকে জানা যায়, হিরুর বোনের খোলা কনিকা আফরোজ এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েট এই ব্যাংকটির শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে। ২০২১ সালের ৫ মে থেকে ২৪ মের মধ্যে এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে কনিকা আফরোজ এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েট। এ সময় তারা মুনাফা করে (রিয়েলাইজড গেইন) ১৫ কোটি ২২ লাখ ৯৯ হাজার ৬০৮ টাকা। আর আনরিয়েলাইজড গেইন হয় ২৩ কোটি ৩৩ লাখ ৮৯ হাজার ৮৭২ টাকা। পরে কনিকা আফরোজ এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটকে জরিমানা করা হয় ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
তালিকাভুক্ত ফরচুন সুজ লিমিটেডের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে হিরুর বাবা আবুল কালাম মাতবর এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েট। ২০২১ সালের ১৭ মে থেকে ২০ মের মধ্যে ফরচুন সুজ লিমিটেডের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে আবুল কালাম মাতবর এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েট। এ সময় তারা মুনাফা করে (রিয়েলাইজড গেইন) ৬ কোটি ১৩ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯২ টাকা। আর আনরিয়েলাইজড গেইন করে ২৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭৭ হাজার ৩৫৫ টাকা। পরে আবুল কালাম মাতবর এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েটকে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে বিএসইসি।
তালিকাভুক্ত বিডিকমের শেয়ার নিয়ে কারসাজিতেও জড়িত দেশ আইডিয়াল ট্রাস্ট কো-অপারেটিভ। বিএসইসির তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ৭ মার্চ থেকে ১০ মার্চের মধ্যে বিডিকমের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে ডিআইটি কো-অপারেটিভ এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েট। মুনাফা করে (রিয়েলাইজড গেইন) ২ কোটি ৬৫ লাখ ২৬ হাজার ৭৬০ টাকা। এ সময় তাদের আনরিয়েলাইজড গেইন হয় ১৮ কোটি ৯ লাখ টাকা। বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটিকে জরিমানা করা হয় ৫৫ লাখ টাকা।
২০২১ সালের ১১ নবেম্বর থেকে ২০২২ সালের ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত কারসাজির মাধ্যমে ওয়ান ব্যাংকের শেয়ারের দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখে আবুল কালাম মাতবর এ্যান্ড এ্যাসোসিয়েট। আর এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা করে (রিয়েলাইজড গেইন) ১৪ কোটি ৩৫ লাখ ৬৪ হাজার ৪৩৭ টাকা। আর আনরিয়েলাইজড গেইন দাঁড়ায় ১৪ কোটি ৩৮ লাখ ১১ হাজার ৬৬ টাকা। কিন্তু তাদের জরিমানা করা হয় ৩ কোটি টাকা।