উবার অর্থনীতি
প্রযুক্তির এক অপার বিস্ময় উবার। সাধ থাকলেও যাদের সাধ্য হয় না এমন মধ্যবিত্তের কাছে উবার এসেছে আশীর্বাদ হয়ে। স্বস্তিদায়ক ভ্রমণ, ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো, কিংবা নিরাপত্তার ব্যাপারটি চিন্তা করলে গণপরিবহনগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপযুক্ত। আর চাইলেই গাড়ি পাওয়াটা যে কতটা দুষ্কর, তা শুধু জরুরী প্রয়োজনগুলোতেই অনুভব করা যায়। আর ঠিক এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টাই মূলত উবারকে একটি পরিপূর্ণ ব্যবসায়িক মডেলে রূপান্তরিত করেছে, দাঁড় করিয়েছে প্রায় বাহাত্তর বিলিয়ন ডলারের বিশাল সাম্রাজ্যে।
বাংলাদেশে ২০১৬ সালের ২২ নবেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এ্যাপের মাধ্যমে ট্যাক্সি সেবাদানকারী কোম্পানি উবারের যাত্রার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের জীবনে স্বস্তি ফিরে আসে। প্রযুক্তির এই উদ্ভাবন শুধু জীবনযাপনকেই সহজ করছে না, একইসঙ্গে বহু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জিডিপিতেও অবদান রাখছে।
প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে বহু শিক্ষিত যুবকও সাময়িক পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে উবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালীন সোহাগ ইসলাম শখের বসে একটি বাইক কিনেছিল। এখন গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেও পাচ্ছেন না একটি কাক্সিক্ষত চাকরি। বর্তমানে তিনি উবার চালিয়ে নিজের হাত খরচ ও পরিবারে কিছুটা অবদান রাখছে। এমন অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়ে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন রাইড শেয়ারিং এ্যাপ উবারকে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি উবার ব্যবহার করা হয় অফিসে যাওয়া আসার জন্য। আবার বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের নিমন্ত্রণ রক্ষার্থেও উবার ব্যবহার করা হয়। ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উবারের প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন চলতি মাসের ৪ তারিখ প্রকাশিত হয়। জানা যায়, দেশে বর্তমানে ২০ লাখ উবারের গ্রাহক রয়েছে। গণপরিবহনের অভাব এবং অব্যবস্থাপনার জন্য এর গ্রাহক বাড়ছে। রাইড শেয়ারিং এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের ভোক্তা পর্যায়ে ৭ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত হয়েছে, যা জিডিপির শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ।
উবারের ৭৩ শতাংশ চালক ২০২১ সালে বাড়তি ৫২ দশমিক ২ কোটি টাকা আয় করেছেন। এ ছাড়া ৭৩ শতাংশ চালক উবার এ্যাপ ব্যবহারে সন্তুষ্টি ও ২০ শতাংশ অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। নারী যাত্রীদের ৭২ শতাংশ জানিয়েছেন, উবার ব্যবহারের ফলে রাতে গন্তব্যে ফেরা সহজ হয়েছে। ৮৪ শতাংশ যাত্রী জানিয়েছেন, উবারের সেবার কারণে তারা গাড়ি না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান উবার হলো স্মার্টফোনের এ্যাপভিত্তিক ট্যাক্সি সেবার নেটওয়ার্ক। আমেরিকাভিত্তিক অনলাইন পরিবহন কোম্পানি উবারের নিজস্ব কোন ট্যাক্সি নেই। এই প্রতিষ্ঠানের কিছু নির্ণায়ক যোগ্যতা পূরণ করে ব্যক্তিগত গাড়ি আছে এমন যে কোন ব্যক্তিই এই এ্যাপভিত্তিক ট্যাক্সি সেবায় নিজেকে যুক্ত করতে পারে। উবারের মাধ্যমে ২০২১ সালে দেশের অর্থনীতিতে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা যুক্ত হয়েছে।
‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা’ ২০১৭ এর নীতিমালায় যা আছে- প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনের মালিককে বিআরটিএ এর তালিকাভুক্ত হতে হবে, রাইড শেয়ারিং সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের সার্ভিস এলাকায় অফিস থাকতে হবে, যাত্রীর অভিযোগ জানানোর সুযোগ রাখতে হবে, এ্যাপে এসওএস সুবিধা রাখতে হবে, যাতে স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গেই চালক ও যাত্রীর লোকেশন ৯৯৯ নম্বরে চলে যায়, এ্যাপে অভিযোগ দায়ের ও নিষ্পত্তির সুবিধা থাকতে হবে, রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের কল সেন্টার প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখতে হবে।
তবে বর্তমানে অধিকাংশ উবার চালকরাই এসব নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না। গ্রাহক থেকে নানা রকম অনিয়মের অভিযোগ আসলেও কার্যত কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হচ্ছে না। উল্টো যাত্রীরাই হয়রানির শিকার হচ্ছে। জানা যায়, কোন যাত্রী অনুরোধ ক্যানসেল করলে তার জরিমানা গুনতে হয়েছে। কিন্তু উবার চালকরা একই কাজ হরহামেশা করছে এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
উবার সেবায় যেসব অভিযোগ আসে- গন্তব্য শুনে চালকদের পছন্দ না হলে অনুরোধ ক্যানসেল করে দেয়া, বিকাশে বা কার্ডে টাকা নিতে অপারগতা প্রকাশ, এ্যাপে যেতে রাজি না হওয়া এবং দরকষাকষি করা, সহজ পথে না গিয়ে গুগল ম্যাপের অযুহাতে ঘুরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো। তবে চালকরা বলেছেন, এ্যাপের মাধ্যমে গেলে সার্ভিসদাতা প্রতিষ্ঠান ২৮ শতাংশ টাকা কেটে নেয়। এ কারণে অনেক চালকই চুক্তিভিত্তিক যাত্রী নিতে চান।
বিআরটিএ এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে উবার আয় করেছে ৩৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। সম্ভাব্য আয় ধরা হয়েছিল ২৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। প্রত্যাশার থেকেও বেশি হয়েছে ১১ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এর বিশেষ কারণ হলো করোনা-পরবর্তী সময়ে সব ধরনের অফিস খুলে দেয়া এবং ভ্রমণের জায়গা উন্মুক্ত হওয়া।
উবারের উদ্ভাবক কানাডিয়ান উদ্যোক্তা গ্যারেট ক্যাম্প। একদিন সন্ধ্যায় তার বন্ধুদের সঙ্গে রাতে ঘুরে বেড়ানোর অভিপ্রায়ে শহরের রেন্ট-এ-কার থেকে একজন ড্রাইভারসহ গাড়ি ভাড়া নেন। রাতভর শহরব্যাপী ঘুরে বেড়িয়ে প্রত্যেককে নিজ নিজ বাসায় পৌঁছে দিয়ে ৮০০ ডলার পে করে ড্রাইভারকে বিদায় দেন। সেই সঙ্গেই জন্ম নেয় এমন একটি আইডিয়ার, যেটি কিছুদিন পরেই সবার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সমাধানের সঙ্গে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায়িক মডেলে পরিণত হয়।
২০০৯ এর শুরুর দিকে বিদেশী কোম্পানি ‘স্টাম্বলআপন’-এর সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ক্যাম্প তার নিজস্ব সাইড প্রজেক্ট হিসেবে উবার ক্যাবের কার্যক্রম শুরু করেন। ২০১০ সালে কোম্পানিটি মাত্র তিনটি গাড়ি নিয়ে নিউইয়র্কে তাদের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করে এবং মে মাসে একটি পরিপূর্ণ কোম্পানি হিসেবে সানফ্রান্সিসকোতে যাত্রা শুরু করে। যার ব্যাপ্তি বর্তমানে পৃথিবীর ৬৩টি দেশ ও ৭৮৫টিরও বেশি শহরে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উবারের প্রভাব শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে এই রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান ভোক্তাদের কাছ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা আয় করেছে। একই সঙ্গে বছরে আনুমানিক ১ কোটি ৭০ লাখ ঘণ্টা সময় সাশ্রয় হয়েছে। উবারের বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারত প্রধান মোঃ আরমানুর রহমান বলেছেন, ‘বাংলাদেশজুড়ে বিশটি শহরে সেবা সম্প্রসারণ করতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। এর মাধ্যমে যাত্রী ও চালক সবাই আমাদের সেবা নিতে পারছেন। উবারের কাছে কমিউনিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা গর্বিত যে, সাড়ে পাঁচ বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে এসব শহরের মানুষদের জীবনে আমরা ছাপ ফেলতে পেরেছি। গ্রাহকদের যাতায়াতের চাহিদা পূরণে দ্বিগুণ উদ্যমে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এ জন্য বাজারে কোন পণ্যের প্রয়োজনীয়তা বেশি, সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছি। আমাদের যাত্রা সবে শুরু হয়েছে। সামনের বছরগুলোতে আরও অনেক মাইলফলকের অর্জন উদযাপনের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।’
প্রথম দিকে উবার ছাড়াও দেশে স্যাম, পাঠাও, আমার রাইড, মুভ, বাহন, চলো এ্যাপে, ট্যাক্সিওয়ালা, ওই খালি, ইজিয়ার, লেটস গো ইত্যাদি নামে বিভিন্ন কোম্পানি এ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবার কাজ শুরু করলেও অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। উবার নিজেদের সাম্রাজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সেক্টরগুলোতে সেবার পরিমাণও বাড়াতে থাকে। তার মধ্যে ফুড ডেলিভারি সার্ভিস, ‘উবারইটস’ এবং কুরিয়ার সার্ভিস ‘উবাররাশ’ বেশ জনপ্রিয়।
অন্যদিকে ‘উবারপুল’ সার্ভিসটিতে উবার নিবন্ধিত চালকরা একই রাইডে একাধিক যাত্রী বহন করতে পারবে, যা চালক এবং আরোহী দু’দলের জন্যই লাভজনক। লাক্সারি রাইডের প্রয়োজন হলে ‘উবারসাব’ উবারব্লাকের মতো আরেকটি বিকল্প ব্যবস্থা।
রাজধানীর ফার্মগেটে অবস্থান করছেন সালমা হক নামের এক নারী। রয়েছে একটি সন্তান। স্বামী থাকেন বিদেশে। বহুবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একটি গাড়ি কিনবেন। তবে যখন থেকে উবারের যাত্রা শুরু হয়েছে। তখন তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। চাইলেই ঘরে বসে কনফার্ম করছেন কোথায় আছে তার কাক্সিক্ষত যানবাহনটি। তাই ব্যক্তিগত কার না থাকা সত্ত্বেও এখন আর গাড়ি কেনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন না।
সালমা হকের মতো এমন অনেক পরিবার আছে যারা গাড়ি কিনতে সমর্থ হলেও উবারের ট্যাক্সি সেবার কারণে কিনছেন না। তবে বর্তমানে উবারের বিকল্প কোন ট্যাক্সি সেবা না থাকায় গ্রাহকরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। বিদেশী কোম্পানি উবারের সেবায় আরও স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নিয়মবহির্ভূত যে কোন কাজে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।