
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে এসএমই
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতে এসএমই (স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ) বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত। এই খাত দেশের মোট উৎপাদন, রপ্তানি এবং কর্মসংস্থানে অনেক অবদান রাখছে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরের ক্ষেত্রে এই শিল্প খাত কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে প্রায় ৭৮ লাখ এসএমই প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা দেশের মোট শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯০ শতাংশ। এই খাত প্রায় ২৫ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং দেশের জিডিপিতে প্রায় ২৫ শতাংশ অবদান রাখে। এসএমই খাতের অধীনে রয়েছে হস্তশিল্প, বস্ত্র ও পোশাক শিল্প, চামড়া ও পাদুকা শিল্প, কৃষিভিত্তিক প্রক্রিয়াজাত শিল্প, তথ্য প্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক্স, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রভৃতি। এই শিল্প একদিকে যেমন উদ্যোক্তা তৈরি করছে, অন্যদিকে তেমনি স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখছে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বর্তমানে এসএমই খাত নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এর মধ্যে অন্যতম হলো অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, দক্ষ মানবসম্পদের সংকট, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও সহায়তা না পাওয়া। এছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠান অনানুষ্ঠানিক খাতে পরিচালিত হওয়ায় সরকারি সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়। তবে সম্ভাবনাও কম নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ফলে ই-কমার্স ও আইটি-ভিত্তিক সেবা খাতে এসএমই উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন।
নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সরকার ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় এখন এসএমই ফাইন্যান্সিং, প্রশিক্ষণ এবং বাজার সংযোগে নতুন দরজা খুলছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত কেবল অর্থনীতির গতি বাড়াচ্ছে না দারিদ্র্য হ্রাসেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এটি বৃহৎ শিল্পের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম পুঁজি এবং কম সময়ে গড়ে ওঠে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অপরিসীম অবদান এবং এর চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরতে প্রতি বছর ২৭ জুন বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) দিবস। এ দিবস পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে জাতিসংঘ। ২০১৭ সালে প্রথম পালিত হয় এ দিনটি। বিশ্ব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দিবস ২০২৫- এর প্রতিপাদ্য - টেকসই প্রবৃদ্ধি ও উদ্ভাবনের চালিকা শক্তি হিসেবে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (এসএমই) ভূমিকা জোরদারকরণ।
গ্রামীণ ও শহর উভয় পরিবেশেই এই খাত দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এসএমই খাতে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা অধিক দৃশ্যমান। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এনজিও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ঋণ সুবিধা ও প্রশিক্ষণ চালু করেছে। তবে দেশে এসএমই উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার বাস্তব চিত্রটি এখনো বেশ চ্যালেঞ্জিং। এ খাতে ঋণের চাহিদা অনেক, তবে অনেক উদ্যোক্তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঋণ পাওয়ার জন্য প্রস্তুত নন। বিশেষ করে অনেকেরই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ট্রেড লাইসেন্স কিংবা ট্রানজেকশন রেকর্ড নেই, যা ব্যাংকিং প্রক্রিয়ার অন্যতম শর্ত।
ব্যাংকের প্রথাগত ঋণপ্রক্রিয়া ও জটিল কাগজপত্রের কারণে নতুন বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সহজেই পিছিয়ে পড়েন। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য চিত্রটি আরও কঠিন। কারণ তারা পরিবার বা সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রয়োজনীয় সাহায্যটুকু অনেক ক্ষেত্রে পান না। অনেক সময় উদ্যোক্তারা ঋণের শর্তাবলি ঠিকভাবে বুঝতে পারেন না, যার ফলে সঠিকভাবে আবেদন করতে পারেন না। রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি এ ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজন।
সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের এগিয়ে যেতে হলে মূলত চার ধরনের সহায়তা জরুরি। অর্থায়নের সহজপ্রাপ্যতা, দক্ষতা উন্নয়ন, বাজার সংযোগ ও ডিজিটাল সক্ষমতা। দেশের নীতিনির্ধারক মহল এ বিষয়গুলো অনেকটাই উপলব্ধি করেছে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই নীতিমালা, পুনর্অর্থায়ন স্কিম, ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম। এসব উদ্যোগ উদ্যোক্তাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে সহায়ক হয়েছে। তবে মাঠপর্যায়ে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। অনেক উদ্যোক্তা এখনো ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় অনভ্যস্ত, তাদের জন্য জামানতের শর্ত পূরণ করা কঠিন। এসব কারণে অনেকে কাক্সিক্ষত সহায়তা পান না।
বাংলাদেশের সিএমএসএমই খাত সামগ্রিক অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। দেশে এখন ১ কোটির বেশি এসএমই উদ্যোক্তা সক্রিয় রয়েছে এবং ৩ কোটির বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই খাতের সঙ্গে যুক্ত। শিল্প খাতে মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৭ শতাংশই আসে এই খাত থেকে।
এসএমই খাত বাংলাদেশের জন্য একটি ‘সাইলেন্ট রেভল্যুশন’ সৃষ্টি করতে পারে যদি এর সঠিক বিকাশ ঘটে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার, সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা, প্রযুক্তি সহায়তা, উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, কর ছাড় ও প্রণোদনা, বাজার সংযোগ বৃদ্ধি, নারী ও তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা পরিকল্পনার ব্যবস্থা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত টেকসই উন্নয়নের একটি বাস্তব রূপ। এ খাতে বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা যত বাড়বে, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হবে তত ত্বরান্বিত।
একজন এসএমই উদ্যোক্তার গল্প দিয়ে লেখাটা শেষ করব- উদ্যোক্তা সাইকা ইকবাল। ইডেন কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। যখন মা হলেন তখন সন্তানকে সময় দেয়ার জন্য চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। এরপর তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা হলেন। তার প্রতিষ্ঠান ‘সুফিয়ানা দি গ্লামার।’ তার ব্যবসা বুটিকস পণ্য নিয়ে। ওয়ান পিছের ডিজাইন তিনি নিজেই করছেন।
মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন তার ব্যবসা। নিজস্ব শোরুম বা কারখানা নেই। অন্যের কারখানা থেকে জামা-কাপড় তৈরি করেন। সাইকা ইকবাল অনলাইন ও বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করে মাসিক ৫০ হাজার টাকা আয় করছেন। ২০১৬ সালের শেষ দিকে সুফিয়ানা দি গ্ল্যামারের যাত্রা শুরু হয়েছিল। শুরুর গল্পটা মসৃণ ছিল না। পাশের মানুষের সহযোগিতা তেমন পায়নি একমাত্র ভাই ছাড়া। এখন অনেকেই তাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন কেননা তার সফলতা সুনিশ্চিত। সুফিয়ানা দি গ্ল্যামারের পরিধি আরও অনেক বাড়াতে চান বলে আশা প্রকাশ করছেন সাইকা ইকবাল।