ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

কালারবাজারে বছরে বিক্রি হয় প্রায় তিন কোটি টাকার বাঁশ

শতাব্দী প্রাচীন গ্রামীণ বাঁশের হাট

আবুল ফজল মো. আবদুল হাই

প্রকাশিত: ২১:৩৪, ২৮ জুন ২০২৫

শতাব্দী প্রাচীন গ্রামীণ বাঁশের হাট

শতাব্দী প্রাচীন গ্রামীণ বাঁশের হাট

মৌলভীবাজার জেলা চা বাগান বেষ্টিত পাহাড়ি এলাকা হওয়াতে এখানে রয়েছে নানা প্রজাতির বাঁশের প্রচলন। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের বাঁশ পাওয়া যায়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুলি বাঁশ, তলটা বাঁশ, মিটুলি বাঁশ, ফারুয়া বাঁশ এবং অন্যান্য প্রজাতি। মৌলভীবাজার জেলায় মূলত মুলি বাঁশ, ঢলু বাঁশ এবং অন্যান্য স্থানীয় প্রজাতির বাঁশ বেশি দেখা যায়। এ জেলার নামকরা  চুঙ্গা পিঠা তৈরি হয় ঢলু বাঁশ দিয়ে। বহুতল ভবন নির্মাণের সহায়তা, সীমানা চিহ্নিতকরণের নিরাপত্তাজনিত বেড়া তৈরি কিংবা বাঁশের তৈরি বিভিন্ন কুটিরশিল্পের উপকরণ তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে লাগে বাঁশ। প্রকৃতির একটি অস্থায়ী বৃক্ষনির্ভর উপাদান এটি।
এক পাশে বয়ে যাচ্ছে খর¯্রােতা কুশিয়ারা নদী আর অপরপাশে মাছ ও শস্যভান্ডার হিসেবে খ্যাত বিস্তৃত হাওর কাউয়াদীঘি। এর মাঝে শত বছরের প্রাচীন গ্রাম্য বাঁশের হাট কালারবাজার। কালারবাজার নামে পরিচিত হলেও হাটটির আরেক নাম হল নলুয়ারমুখ বাজার। আর এ বাজারে বছরে কমপক্ষে তিন কোটি টাকার বাঁশ বিক্রি হয়।
সুপ্রাচীন এ বাজারটির অবস্থান মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার ২ নম্বর উত্তরভাগ ইউনিয়নে। শুধু রাজনগর উপজেলা বা মৌলভীবাজার জেলা নয়, সমৃদ্ধ এ বাজারটির পরিচিতি রয়েছে পুরো সিলেট অঞ্চলে। বাজারে অন্যান্য পণ্য সামগ্রী পাওয়া গেলেও ‘বাঁশের বাজার’ হিসেবে কালারবাজারের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্রই।
কালারবাজার বা নলুয়ারমুখ বাজারের বাঁশ ব্যবসায়ী ও স্থানীয় লোকজন জানান, কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী ও কাউয়াদীঘি হাওড়পারের কালারবাজারে ১৯১৫ বা উনিশ শত বিশ সালের দিকে কুশিয়ারা নদী ও কাউয়াদীঘি হাওড় পাড়ের বাসিন্দাদের কেন্দ্র করে কালারবাজার নামে খুবই ছোট আকারে গড়ে উঠেছিল একটি গ্রামীণ বাজার। ওই সময়ে সপ্তাহে দুইদিন সন্ধ্যার পর থেকে রাত ৯টা-১০টা অবধি কুপি বাতির আলোতে চলত বাজারের কার্যক্রম।

বাজারটি থেকে আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যেতেন। বাজার প্রতিষ্ঠার সময়েই বাজারের গড়ে তোলা হয় ‘বাঁশের হাট’। ওই সময়ে এলাকার মানুষের একমাত্র ভরসা ছিল পানিপথ। সড়ক যোগাযোগ না থাকায় তৎকালীন সময়ে সিলেট জেলার বালাগঞ্জ, হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ ও আজমিরিগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন কালারবাজারে এসে বাঁশ কিনে নৌকা ও লঞ্চযোগে নিয়ে যেতেন নিজ নিজ গন্তব্যে।

ধীরে ধীরে বাজারের পরিধি যেমন বাড়তে থাকে, তেমনি বাড়তে থাকে বাঁশের হাটের পরিধিও। বর্তমানে হাওড়ের বুক চিড়ে হয়েছে পাকা সড়ক। এখন কালাবাজার থেকে বাঁশ কিনে বিভিন্ন যানবাহনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাওয়া যায়। মৌলভীবাজারের সবচেয়ে বড় বাঁশ বাজারে এখন ৫০ জনের মতো বাঁশ ব্যবসায়ী থাকলেও নিয়মিত বাঁশের ব্যবসা করছেন প্রায় ৩০ জন ব্যবসায়ী।
কালারবাজারের ব্যবসায়ী মির্জা মো. তুরন মিয়া বলেছেন, ‘আমাদের বাজারের বাঁশের সুনাম পুরো সিলেট অঞ্চলে। কালার বাজারটি কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী। নদীর এপার মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলা আর ওপার সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলা। দুই জেলার দুই উপজেলাকে বিভক্ত করেছে কুশিয়ারা নদীটি।

আমাদের বাজারের বাঁশ কুশিয়ারা নদী নৌকায় পাড়ি দিয়ে যায় সিলেট জেলার বিভিন্ন অঞ্চলেও। দাদা-বাবার কাছে শুনেছি এ বাজারটি গড়ে উঠেছিল এক শত বছরেরও আগে। প্রতি হাটবারে অর্থাৎ শুক্রবার ও সোমবারে বাজারে বাঁশ কিনতে সিলেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসেন। তবে শুক্রবারে পুরো জমজমাট হয়ে ওঠে কালারবাজারের বাঁশের হাট। 
শুক্র ও সোমবার বৃহৎ হাট বসলেও বাজারটিতে প্রতিদিনই কম-বেশি বাঁশ বিক্রি হয়। প্রতি হাটে ২-৩ লাখ টাকার বাঁশ বিক্রি হয়। তবে শুক্রবার বেশি বাঁশ বিক্রি হয়। ওই দিন ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার বাঁশ বিক্রি হয়। সিলেট অঞ্চলের মধ্যে কালারবাজার বাঁশের হাট সবচেয়ে বড় ও পুরানো। এখানে দেশে উৎপাদিত সব জাতের বাঁশ পাওয়া যায়। 
জেলা শহর থেকে কালারবাজারে বাঁশ কিনতে এসেছেন নির্মাণাধীন একটি ভবনের ঠিকাদার আবু তাহের। তিনি বলেছেন, সাধারণত সব ধরনের বাড়ি বা ভবনে ঢালাইয়ের সময় বাঁশ খুঁটি হিসেবে ব্যবহার হয়। ভবনের নির্মাণকাজে প্রচুর পরিমাণে বাঁশ লাগে। দুইতলা-পাঁচতলা যাই হোক ভেতরে বা বাইরে, প্রতিটি ফ্লোরে মাচা তৈরি করতে হয় বাঁশ দিয়ে। সেই সঙ্গে এগুলোর খুঁটি হিসেবেও বাঁশের ব্যবহার হয়। এই হাটে চাহিদামতো ও সস্তায় বাঁশ পাওয়া যায়। উত্তরভাগ ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা মহেন্দ্র সরকার।

ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি একজন বাঁশ বেতের কারিগর। গত প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি কালারবাজার থেকে বাঁশ কেনেন। তিনি বলেছেন, ‘কালারবাজার থেকে প্রায় ৪০ বছর ধরে বাঁশ কিনি আমি। সেই বাঁশ দিয়ে টুকরি, কুলা ও খলইসহ নানা সামগ্রী তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে পরিবার চালাই। এই ৪০ বছর ধরেই দেখে আসছি সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলা থেকে মানুষ বাঁশ কিনতে কালারবাজারে আসছেন। এ বাজারের মতো বড় ও পুরানো বাঁশের হাট সিলেট অঞ্চলে আর আছে কিনা আমার জানা নেই।’

×