
তারুণ্যের বাজেট ও কর্মসংস্থান
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে বলা হয়েছে দেশে এক বছরের ব্যবধানে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার। একই সঙ্গে কমেছে কর্মক্ষম ও কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী। বর্তমানে দেশে বেকার ২৭ লাখ ৩০ হাজার। গত অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে বেকারত্বের হার বেড়ে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে পৌঁছেছে। আগের বছরের একই সময়ে এ হার ছিল ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
১৩তম আইসিএলএসে ডিসেম্বর শেষে দেশে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে এ হার ছিল ৩ দশমিক ২০ শতাংশ। প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী, ২৬ লাখের মধ্যে দেশে পুরুষ বেকারের সংখ্যা ১৮ লাখ আর নারী ৮ লাখ ২০ হাজার জন। কৃষি, সেবা ও শিল্পÑ সব খাতেই কমেছে কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী। নারীর চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেড়েছে বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের তুলনায় দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমেছে ১৭ লাখ ২০ হাজার। ২০২৩ সালে যেখানে এই সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার, ২০২৪ সালে তা নেমে এসেছে ৭ কোটি ১৭ লাখ ৩০ হাজারে। কমেছে যুব শ্রমশক্তিও। ২০২৩ সালে দেশে যুব শ্রমশক্তি ছিল ২ কোটি ৬৭ লাখ জন, ২০২৪ সালে তা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২৬ লাখে। বর্তমানে কর্মে নিয়োজিত গোষ্ঠীর সংখ্যা ৬ কোটি ৯১ লাখ ১০ হাজার জন, যা ২০২৩ সালে ছিল ৭ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার জন। অর্থাৎ এক বছরে কাজ হারিয়েছে অন্তত ১৮ লাখ ৭০ হাজার মানুষ।
অন্যদিকে শ্রমশক্তির বাইরে থাকা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০২৩ সালে ছিল ৪ কোটি ৭১ লাখ ৭০ হাজার, যা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৫০ হাজারে। বিষয়টা উদ্বেগজনক এই কারণে, বেকারত্বের রাজনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাত কারও জন্য সুখকর নয়। বৈধ আয়ের পন্থা না পেলে অনেকে জীবিকা নির্বাহে ক্ষেত্রবিশেষে নীতি-নৈতিকতাও বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না।
সমাজবিজ্ঞানীরা তাকেই চৌর্যবৃত্তি, ডাকাতি, রাহাজানির ন্যায় নানাবিধ অপরাধ বিস্তারের মোক্ষম কারণ বলে মনে করেন। এমন পরিস্থিতি দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতারও জ্বালানিরূপে সাব্যস্ত হয়ে থাকে।
এই প্রেক্ষাপটে বেকারত্ব নিয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা, তাদের সঙ্গে নাগরিকদেরও মনোজগতে ভাবনার উদয় হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আবার বিবিএস জানায়, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, যারা গত সাত দিনে ১ ঘণ্টার মজুরির বিনিময়ে কাজ পায়নি এবং এক মাস ধরে সক্রিয়ভাবে কাজ খুঁজেছে, কিন্তু পায়নি তাদেরই বেকার হিসেবে গণনা করা হয়। চলতি বছর বিবিএস প্রথমবারের মতো আইএলওর ১৩তম ও ১৯তম আইসিএলএস (পরিসংখ্যানবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন) অনুযায়ী পৃথকভাবে ফলাফল প্রকাশ করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ‘তারুণ্যের উৎসব’ উদযাপনের জন্য ১০০ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য এমন তহবিল এবারই প্রথম। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশই তরুণ, যারা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। উন্নত দেশে বাজেট পরিকল্পনায় তরুণদের সবচেয়ে বড় চাহিদা হিসেবে বিবেচিত হয় শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানি ও ফিনল্যান্ড বাজেটে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করে।
বিশ্বের উন্নত দেশের সরকার বাজেটের মাধ্যমে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেয়। বাংলাদেশ সরকার এই প্রথমবারের মতো এ ধরনের একটি প্রশংসিত উদ্যোগ হাতে নিয়েছে।
সম্প্রতি জাতীয় বাজেট ও পরিকল্পনা বিষয়ক সামাজিক প্ল্যাটফর্ম ডেমোক্রেটিক বাজেট মুভমেন্ট (ডিবিএম) পরিচালিত একটি অংশগ্রহণমূলক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ৬০ শতাংশ প্রকল্পে সরাসরি তরুণদের সংশ্লিষ্টতা নেই।
নয় জেলার তরুণদের ওপর পারসেপশন স্টাডিতে দেখা যায়, প্রান্তিক তরুণসহ তরুণ নারী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার তরুণ, তরুণ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী এবং জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের তরুণরা জাতীয় পরিকল্পনা, বাজেট প্রক্রিয়া ও প্রণোদনায় প্রায় অনুপস্থিত।
গবেষণায় উঠে আসে, তারুণ্যের বাজেটের সফল বাস্তবায়নে নানামুখী কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে, যা শুধু বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ নয়, বরং এর গুণগত কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তরুণদের সম্ভাবনা ও প্রয়োজন বিবেচনায় এনে এই বাধাগুলো চিহ্নিত করা জরুরি।
বাংলাদেশে এখনো ইয়ুথ ডিস-অ্যাগ্রিগেটেড ডাটা বা তরুণদের বয়স, লিঙ্গ, এলাকা, প্রতিবন্ধিতা বা শিক্ষা অনুসারে পৃথক উপাত্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে গড়ে ওঠেনি। স্থানীয় প্রশাসন ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অনেক কর্মকর্তা ইয়ুথ সেনসেটিভ বাজেটিং সম্পর্কে প্রশিক্ষিত নন। এতে তারুণ্যের বাজেটের প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দেখা দেয়, বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে।
তরুণ প্রজন্ম সাধারণত পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। তাই উন্নত বিশ্ব তরুণদের আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে বাজেটে সবুজ অর্থনীতি, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং টেকসই উন্নয়ন খাতে বড় আকারে বিনিয়োগ করে।
বাংলাদেশে ৯০ দশক থেকে প্রবৃদ্ধির হার বাড়তে শুরু করলেও তরুণদের কর্মসংস্থানের দিকে কোনো সরকারই নজর দেয়নি। শুরুতে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে মূলত শ্রমঘন তৈরি পোশাক খাতের ওপর ভর করে। তবে কালক্রমে তুলনামূলক কম শ্রমঘন নিট পোশাকের হিস্যা বেড়েছে; তাতে তরুণদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমতে শুরু করে। সঙ্গে এসেছে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন।
প্রায় এক দশক ধরে পোশাক খাতের তরুণদের মোট কর্মসংস্থান তেমন বাড়েনি। এমনকি বিজিএমইএর ওয়েবসাইটে কর্মসংস্থানের উপাত্তও আর পাওয়া যায় না।
দেশের অর্থনীতি বিশেষ করে রপ্তানি একটি মাত্র শিল্পের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হওয়ায় গবেষক-বিশ্লেষকরা বহুবার শিল্পের বৈচিত্র্যকরণের কথা বললেও নীতিকৌশল পর্যায়ে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি।
ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। এখন রপ্তানি বাড়লেও শিল্প খাতের কর্মসংস্থান প্রায় স্থবির।
এখন জরুরি হলো অর্থনীতির চাকা সচল করে প্রবৃদ্ধির পথে হাঁটা।
প্রবৃদ্ধি হলেও তা যেন কর্মসংস্থানহীন না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া। তার জন্য প্রয়োজন হবে কৃষি, রেমিটেন্স আর পোশাক রপ্তানিভিত্তিক কাজের রূপান্তর ঘটানো। তার সঙ্গে দৃষ্টি দিতে হবে হতাশ মানুষকে শ্রমবাজারে ফিরিয়ে শ্রমশক্তি বাড়ানো এবং নারী ও যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর মতো চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে।